মার্কিন উসকানি কতক্ষণ মানবে চীন?

চরচা ডেস্ক
চরচা ডেস্ক
মার্কিন উসকানি কতক্ষণ মানবে চীন?
প্রতীকী ছবি: রয়টার্স

তাইওয়ানের কাছে আমেরিকা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অস্ত্র বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই অস্ত্রচুক্তির মূল্য ১১ বিলিয়ন ডলারের বেশি। যা টাকার অংকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে এটি দ্বিতীয় বড় চুক্তি। এই চুক্তির ফলে আমেরিকা ও চীনের সম্পর্ক আরও চাপে পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

চীন ইতিমধ্যেই তাইওয়ানের ওপর সামরিক ও কূটনৈতিক চাপ বাড়াচ্ছে। কারণ বেইজিং তাইওয়ানকে নিজের ভূখণ্ড বলে দাবি করে। এই ধরনের পরিস্থিতি তাইপেকে সতর্ক করে তুলেছে।

চীন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাইওয়ানকে ঘিরে ক্রমশ সামরিক শক্তি প্রদর্শন করছে। নিয়মিত সামরিক মহড়া চালাচ্ছে। তাইওয়ানের জলসীমা ও আকাশসীমায় নিয়মিত ঢুকে পড়ছে। বেইজিং তাইওয়ানকে একটি বিচ্ছিন্ন প্রদেশ হিসেবে দেখে। চীন বহুদিন ধরেই দ্বীপটির নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের করতে চায়।

অন্যদিকে তাইওয়ান বলছে, চীনের যেকোনো আগ্রাসন ঠেকাতে তাদের আরও শক্তিশালী সামরিক সক্ষমতা প্রয়োজন। এ কারণে তারা আবারও ওয়াশিংটনের কাছে সহায়তার আহ্বান জানিয়েছে। এই নতুন অস্ত্র প্যাকেজটি তারই অংশ। হোয়াইট হাউস বলছে, এই অস্ত্র বিক্রি আমেরিকার জাতীয় অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাগত স্বার্থ রক্ষা করবে।

অনলাইনে দেওয়া এক বিবৃতিতে তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এজন্য ট্রাম্প প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। একই সঙ্গে তারা কোন কোন সামরিক সরঞ্জাম কিনছে, তার বিস্তারিতও জানিয়েছে।

এই চুক্তির আওতায় রয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র। আছে হাউইটজার কামান। রয়েছে জ্যাভেলিন অ্যান্টি-ট্যাংক ক্ষেপণাস্ত্র। রয়েছে লয়টারিং মিউনিশন ড্রোন। এছাড়া অন্যান্য সরঞ্জামের খুচরা যন্ত্রাংশও অন্তর্ভুক্ত আছে।

তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো হাই-মোবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেম, বা হাইমার্স। শুধু এই সিস্টেমেরই মূল্যই প্রায় ৪০০ কোটি ডলার।

এই চুক্তির খবরে চীন স্বাভাবিকভাবে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বেইজিং বলেছে, তাইওয়ান প্রশ্নে চীনের দৃঢ় সংকল্পকে কেউ যেন হালকাভাবে না নেয়। চীনের অভিযোগ, আমেরিকা উন্নত অস্ত্র সরবরাহের একটি বড় কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এটি ‘এক চীন’ নীতি ও চীন– আমেরিকা যৌথ ঘোষণার লংঘন।

চীনের মতে, এই চুক্তি তাদের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করে।

এটি তাইওয়ান প্রণালির শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্যও বড় ধরনের হুমকি। তবে এই অস্ত্রচুক্তি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন কংগ্রেসের অনুমোদন পায়নি। তবে আশা করা হচ্ছে, দুই দলের সমর্থনের কারণে এটি সহজেই কংগ্রেসের অনুমোদন পাবে। কারণ তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা বিষয়ে আমেরিকায় একটি রাজনৈতিক ঐকমত্য রয়েছে।

প্রশ্ন হলো, আমেরিকার এই সিদ্ধান্তের পেছনে কারণ কী। কেন এখনই এই চুক্তি করতে হচ্ছে? যখন বাণিজ্যে অতিরিক্ত শুল্ক বা ট্যারিফ নিয়ে চীন ও আমেরিকা একটা সমঝোতায় পৌঁছেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্ট্রাটেজিতে বারবার তাইওয়ান নিয়ে চীনের সাথে সংঘাত এড়ানোর কথা বলেছেন। তারপরও এই ধরনের উসকানি কেন?

বিশ্লেষকদের মতে, এই অস্ত্র বিক্রি আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সেই কৌশলে বলা হয়েছে, তাইওয়ানকে ঘিরে সম্ভাব্য সংঘাত প্রতিরোধ করা এশিয়ায় আমেরিকার একটি অগ্রাধিকার। অতএব, এই অস্ত্রচুক্তির প্রস্তুতি অনেক দিন ধরেই চলছিল।

তাইওয়ানের ক্ষমতাসীন দল আবার চীনকে মোকাবিলায় সম্প্রতি সাত বছরের একটি অস্ত্র প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এই প্যাকেজের মূল্য ৪০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এর লক্ষ্য হলো দেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়ানো।

এদিকে, আমেরিকা ও তার মিত্ররা অঙ্গীকার রক্ষায় কতটা প্রস্তুত-সে বিষয়ে তাইওয়ান সন্দিহান ছিল। এই অস্ত্রচুক্তি কি তাইপের সেই উদ্বেগ কমাবে?

বিশ্লেষকদের মতে, এই চুক্তি নিঃসন্দেহে তাইওয়ানের জন্য সুখবর। ট্রাম্প প্রশাসন ‘এক চীন’ নীতি মানবে কি না-সে বিষয়ে এই চুক্তি কিছুটা আশঙ্কা কমাবে। একই সঙ্গে তাইওয়ানের প্রতি আমেরিকার প্রতিরক্ষা সহায়তা অব্যাহত থাকবে-এই আস্থাও জোরদার করবে।

এখন পর্যন্ত ট্রাম্প কৌশলগত অস্পষ্টতার নীতি বজায় রেখেছেন। তিনি চীনের চাপের কাছে নতি স্বীকার করেননি। তিনি তাইওয়ানের প্রতি আমেরিকার বিদ্যমান অঙ্গীকার দুর্বল করেননি।

কিন্তু মোদ্দা কথা হচ্ছে এই অস্ত্র-প্যাকেজে এমন কিছু আছে কি, যা তাইওয়ানের আত্মরক্ষার সক্ষমতায় বড় পরিবর্তন আনবে?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অস্ত্রগুলো তাইওয়ানের ‘টি-ডোম’ তৈরির উদ্যোগে সহায়তা করবে। এটি হবে ইসরায়েলের ‘আয়রন ডোম’–এর মতো।

এদিকে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংয়ের এপ্রিল মাসে আমেরিকা সফরের কথা রয়েছে। কিছু দিন আগে দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে সি বৈঠক করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে। এই বৈঠকের পর ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া দেখে সবাই ভেবেছিল, দুই শক্তিধর দেশের মধ্যেকার বরফ গলতে শুরু করছে। কিন্তু তাইওয়ানকে অস্ত্র বিক্রির মার্কিন সিদ্ধান্ত এই সম্পর্ককে জটিল করে তুলতে পারে।

বিশ্লেষকদের মতে, তাইওয়ান চীনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে একই সঙ্গে চীন আমেরিকার সাথে বাণিজ্য স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে চায়। সে কারণে চীন প্রতিক্রিয়া জানাতে হয়তো সতর্ক থাকবে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও তাইওয়ান বিষয়ক দপ্তরের নিন্দাসূচক বক্তব্য সবাই দেখেছে।

আগামী দিনে বেইজিং সামরিক চাপ বাড়াতে পারে। এর মধ্যে তাইওয়ানের আকাশসীমায় অনুপ্রবেশের ঘটনা বাড়তে পারে।

তাইওয়ানের সাথে অস্ত্র চুক্তি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি’ নীতির অংশ। চীনের প্রতি এই প্রশাসনের সামগ্রিক কৌশল দুই ভাগে বিভক্ত। এর উদ্দেশ্য হলো: একদিকে, তাইওয়ানকে শক্তিশালী করে তোলা।

অন্যদিকে, চীনকে আশ্বস্ত করা যে আমেরিকা কমিউনিস্ট পার্টির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করবে না। চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও ঠেকাতে চাইবে না।

ট্রাম্পের এই দ্বৈত নীতি চীন কতদিন সহ্য করবে সেটা লাখ টাকার প্রশ্ন। কারণ প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং অনেক আগেই ঘোষণা দিয়েছেন, ২০২৭ সালের মধ্যে তাইওয়ান হবে চীনের মূল ভূখন্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

সম্পর্কিত