রোকেয়া কেন গুরুত্বপূর্ণ?

রোকেয়া কেন গুরুত্বপূর্ণ?

আজ ৯ ডিসেম্বর, রোকেয়া দিবস। এটি কি নিছক তথ্য হয়ে উঠছে? প্রশ্নটি আসছে প্রেক্ষাপটের কারণে। ‘মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত’ বেগম রোকেয়ার ১৪৫তম জন্মবার্ষিকী পালন বা উদ্‌যাপনের এই মুহূর্তে যখন চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে ৩২২ জন নারীর শুধু পারিবারিক সাহিংসতায় মৃত্যুর তথ্য আমাদের হাতে, তখন প্রশ্নটি গুরুতর হয়ে ওঠে।

রোকেয়ার জন্মবার্ষিকী নিয়ে লেখায় কেন এমন প্রসঙ্গের অবতারণা, তা বুঝতে হলে তাকাতে হবে রোকেয়ার জীবনে। আগেই বলা হয়েছে, বাঙালি নারী, তথা ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত বলা হয় বেগম রোকেয়াকে। আমরা যদি রোকেয়ার সময়কাল দেখি, তাহলে বুঝব তৎকালীন মুসলিম সমাজে একজন নারীর সাহিত্যিক হওয়া এবং সাহিত্যে নারী অধিকার নিয়ে কথা বলা ঠিক কতটা কঠিন ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষা ছাড়া নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়, বিশেষত তৎকালীন মুসলিম সমাজে যেখানে নারীশিক্ষা ছিল বিরল। তিনি মেয়েদের, বিশেষ করে মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ করে দিতে এবং তাদের মধ্যে আত্মমর্যাদা ও সচেতনতা তৈরি করতে ১৯১১ সালে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। নির্বিঘ্নে স্কুলে আসার ব্যবস্থা করতে মেয়েদের জন্য পর্দাঘেরা গাড়ির ব্যবস্থাও করেন।

রোকেয়া গোঁড়া রক্ষণশীল সমাজকে তার লেখনী ও চিন্তার মাধ্যমে বহুভাবে আঘাত করেছেন। এতে তাকে ধর্মবিদ্বেষী- ইসলামবিদ্বেষীও বলা হয়েছে। এ ধারা কি বদলেছে? প্রশ্নটি রেখে গেলাম।

রোকেয়ার লেখা খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, তিনি ইউরোপের আধুনিক সমাজকেও কটাক্ষ করতে ছাড়েননি। রোকেয়া দেখিয়েছেন ধর্মের দোহাই দিয়ে কীভাবে নারীকে বঞ্চিত করা হয়, যেহেতু ধর্ম সবসময় পুরুষদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এমনকি আধুনিক সমাজেও নারীর জন্য যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাও নেয় পুরুষ। এই বিষয়ে রোকেয়া তার লেখায় পার্সী নারীদের উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছিলেন, নারী ঘরের বাইরে আসছে, সেটাও পুরুষের ইচ্ছাতেই।

তার লেখায় ধর্মের চেয়ে নারীমুক্তির অন্তরায় হিসেবে ফুটে উঠেছে নারীর মানসিক দাসত্ব। কিন্তু রোকেয়া এই উপলদ্ধি করেছিলেন যে, সমাজের অর্ধেক যদি পিছিয়ে থাকে, তবে সেই সমাজ এগিয়ে খুব বেশি দূর যেতে পারে না। দ্বিচক্রযান বা সাইকেলের উদাহরণ দিয়ে তিনি বুঝিয়েছেন যে, এক চাকা ছোট হলে সাইকেল সামনে না এগিয়ে একই জায়গায় ঘুরতে থাকে, সমাজও তেমনি নারীকে পেছনে ফেলে সামনে এগোতে পারে না।

এবার একটু দম নিয়ে শুরুতেই উপস্থাপন করা তথ্যের দিকে তাকানো যাক পূর্ণ চোখে। তথ্যটি আইন ও সালিশ কেন্দ্রের। সংস্থাটির তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে মোট ৪০১ জন নারী। শুধু ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৩২২ জন নারী পারিবারিক সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে। তাদের মধ্যে অন্তত ১৩৩ জন নারী স্বামীর হাতে নিহত হয়। একই সময়ে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে স্বামীর নির্যাতনের অভিযোগে ৯ হাজারের বেশি কল রেকর্ড হয়েছে। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৪ সালের নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ নারী কোনো না কোনো ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছে, যার অর্ধেকের বেশি স্বামীর সহিংসতার শিকার।

এই হলো সেই অর্ধাঙ্গীর অবস্থা! রোকেয়া যে সমরূপ, সমভাব চেয়েছিলেন, সাইকেলের দুটি চাকার মতো করে যারা ‘দোঁহে’ মিলে এগিয়ে যাওয়ার কথা, তারই একটি পক্ষ শুধু পৌরুষিক পেশিতে আক্রান্ত করে মেরে ফেলছেন তার সঙ্গীকে। আর সেই ‘সুলতানার স্বপ্ন’, তার ঠাঁই ঠিক কোথায়?

রোকেয়া তার সুলতানার স্বপ্ন, অবরোধবাসিনী, মতিচূর, পদ্মরাগ–এসব বইয়ে নারীদের অবস্থান, মানসিক দাসত্ব ও নারীমুক্তির গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।

১৯০৫ সালে রোকেয়ার সবচেয়ে আলোচিত বই ‘সুলতানার স্বপ্ন’ প্রকাশিত হয়। এই বইয়ে রোকেয়া এক ইউটোপিয়ান সমাজের কথা বলেছেন, যেখানে নারী সর্বময় কর্তা, আর পুরুষ গৃহবন্দী। অর্থাৎ, সমাজব্যবস্থা একই থাকবে, শুধু পুরুষের পরিবর্তে নারীর প্রভুত্ব থাকবে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, রোকেয়ার এ বই কিন্তু ইংরেজিতে লেখা। এ বই যখন প্রকাশ হয়, ইউরোপ ততদিনে নারী আন্দোলনের প্রথম ধাপ অতিক্রম করছে। এ আন্দোলনের ঢেউ এসে লাগছে শিল্প-সাহিত্যেও। ফলে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, রোকেয়ার এ বইয়ের ‘টার্গেট পাঠক’ ছিল ইউরোপীয় বা ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজ। এই ইউটোপিয়া হয়তো তাদের জন্যই, যা একইসঙ্গে উপমহাদেশীয় সমাজে নারীর ওপর চলা দমন-পীড়নের কারণে একজন নারী হিসেবে নিজের ভেতরে থাকা অবদমনেরও ফল।

রোকেয়া মারা গেছেন ৯৫ বছর আগে। এই লম্বা সময়ে পরিবর্তন হয়েছে অনেককিছুই। শিক্ষা থেকে শুরু করে সবকিছুতেই নারীর উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠও রয়েছে।

নারী গতানুগতিক পারিবারিক ভূমিকার দোহাই দিয়ে এখনো এই ২০২৫-এ এসে নারীকে আটকে রাখার নজির কি নেই? খুব সম্প্রতি যদি আমরা দেখি, নারীর কর্মঘণ্টা কমানোর কথা হচ্ছে, কিন্তু নারীকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে না সে আদতে কী চায়।

অনেকে হয়তো বলবেন–মন্দ কী? কারণ, এ প্রস্তাবে কর্মঘণ্টা কমালে একই পারিশ্রমিক দিয়ে পুরুষ বাদ দিয়ে কোনো নিয়োগকর্তা কেন নারীকে নিয়োগ দেবেন, সে প্রসঙ্গ উহ্য থাকছে। কিন্তু এর পেছনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, যখন একই জায়গা থেকে বলা হচ্ছে, যেসব নারী ঘরে থাকবে, তাদেরকে রানীর মর্যাদা দেওয়া হবে। এখানে প্রশ্ন থেকে যায়, যে নারীরা ঘরে থাকে না, তাদেরকে মর্যাদা দেওয়া হবে না? বা রানীর বদলে তাদেরকে কোন শ্রেণিভুক্ত করা হবে? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে–মর্যাদার কর্তা কে?

আরও কিছুটা পেছনে গেলে আমরা দেখব যে, নারী সংস্কার কমিশন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক। একইসময়ে অন্যান্য অনেক বিষয়ভিত্তিক কমিশন হলেও আমরা দেখি বিতর্ক শুধু নারী কমিশন নিয়ে। অভিযোগ–ধর্ম অবমাননার। অন্যান্য কমিশন পুরোপুরি ধর্ম মেনে করা হয়েছে কিনা, সে প্রশ্ন একপাশে সরিয়ে রেখে আমরা দেখি কী ছিল নারী কমিশনে, যা নিয়ে এত বিতর্ক। প্রতিবেদনে নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে মুসলিম, হিন্দু ও খ্রিষ্টান পারিবারিক আইনের সংস্কার করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব আইনের পরিবর্তে অভিন্ন পারিবারিক আইনের মাধ্যমে সব ধর্মের নারীর জন্য বিয়ে, তালাক ও সন্তানের ভরণপোষণে সমান অধিকার নিশ্চিতের জন্য অধ্যাদেশ জারির সুপারিশের পাশাপাশি সব সম্প্রদায়ের জন্য আইনটিকে ঐচ্ছিক রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করে মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মীয় উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করে সম্পদে নারীর ৫০ শতাংশ নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে কমিশন। এর অংশ হিসেবে সিডও সনদের ওপর অবশিষ্ট দুটি সংরক্ষণ প্রত্যাহার এবং আইএলও সনদ সি১৮৯ ও সি১৯০ অনুস্বাক্ষর ও পূর্ণ বাস্তবায়ন করার সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি শ্রম আইনে যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করেছে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন। মোটাদাগে এই হলো নারী কমিশনের সুপারিশ।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নারী সংস্কার কমিশন নিয়ে মূল আপত্তি ওই উত্তরাধিকার নিয়ে। এই এক প্রশ্নে সব পক্ষ একজোট। কারণ, এ বিষয়টি সরাসরি নারীর সত্যিকারের ক্ষমতায়নের সঙ্গে যুক্ত। ফলে এ প্রশ্ন উঠলেই এক দলকে আমরা দেখি বড় মিছিল নিয়ে বেরিয়ে যেতে, হুমকি, ধমকি কোনো কিছুই বাদ যায় না। যতবার এ প্রশ্ন সামনে এসেছে আমাদের বিবিধ সরকার চুপটি করে সুবোধ হয়ে বসে গেছে। মুখে আর রা-টি নেই।

এই পরিস্থিতিতে আমরা বলতেই পারি রোকেয়া আজও প্রায় সমানভাবেই প্রাসঙ্গিক। এটা এতটাই যে, মৃত্যুর ৯৫ বছর পর রোকেয়াকে এখনো প্রাণপনে মুছে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। রোকেয়া তার সমসাময়িক রক্ষণশীল সমাজের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন। আজ এত বছর পরে এসে, এক তথাকথিত আধুনিক সমাজ যেখানে দেশের অর্থনীতিই টিকে আছে অনেকাংশে একটি খাতের নারী কর্মীদের শ্রমের ওপর, সমাজের বিভিন্ন স্তরে নারীর যখন সরব উপস্থিতি, সেই সময়েও প্রায় একইরকম কটাক্ষের শিকার হচ্ছেন রোকেয়া। তার নামে হওয়া একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের চেষ্টা, গ্রাফিতিতে কালো রং দেওয়া কিংবা নিজের অধিকারে সরব হতে চাওয়া যেকোনো নারীকে স্লাটশেমিং করা কিংবা তাদের অস্তিত্বকে মুছে ফেলার চেষ্টার মধ্যে রোকেয়া এবং তার উত্তরসূরী নারীদের নিয়ে সমাজের ভীতিই জানান দেয়। তাই রোকেয়া আজও গুরুত্বপূর্ণ, আজও প্রাসঙ্গিক।

সম্পর্কিত