ফ্ল্যাটটির পুরো মেঝে রক্তে ভেজা

চরচা প্রতিবেদক
চরচা প্রতিবেদক
ফ্ল্যাটটির পুরো মেঝে রক্তে ভেজা
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে এই বাড়ির আটতলার একটি ফ্ল্যাটে খুন হন লায়লা আফরোজ ও তার মেয়ে নাফিসা বিনতে আজিজ। ছবি: চরচা

মোহাম্মদপুরে শাহজাহান রোডের ওই বাড়ির ৭/বি ফ্ল্যাটটি এখনো রক্তে ভেজা। ঘরের দেয়াল তো বটেই লিফটেও আছে রক্তের ছাপ। পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর তদন্তকারী সদস্যরা আলামত সংগ্রহ করছেন।

মোহাম্মদপুরে মা-মেয়ে খুন হয়েছে। পুলিশের ধারণা, খুন করেছে ওই ফ্ল্যাটে গৃহকর্মীর কাজ করা আয়েশা। প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশ বলছে, খুনের পর আয়েশা ওই ফ্ল্যাটের বাথরুমে গোসল করেছেন, এবং তারপর স্কুলড্রেস পরে বের হয়ে যান। পরিচয় লুকাতেই এ কাজ করেছেন বলে ধারণা পুলিশের।

গৃহকর্মী আয়েশা (২১)। পরিচয় দিয়েছেন, তার গ্রামের বাড়ি রংপুরে। একটি দুর্ঘটনায় বাড়িতে আগুনে পুড়ে বাবা-মা মারা গেছে। আর তিনিও দগ্ধ হন। মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে এক আত্মীয়ের সঙ্গে থাকেন। কাজের সন্ধানে ঢাকায় এসে গৃহকর্মীর কাজ খুঁজছেন–এমন অনুরোধে গলে যান মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডের ৩২/২/এ ভবনের সিকিউরিটি গার্ড আব্দুল খালেক। আর কাজে নিয়োগের চারদিনের মাথায় সেই আয়েশার হাতেই মা-মেয়ে খুন হয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে পুলিশ।

এদিকে ওই ভবনের অষ্টম তলার ৭/বি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা স্কুলশিক্ষক এম জেড আজিজুল ইসলাম ও তার স্ত্রী এবং তাদের এক মেয়ে বসবাস করেন। তিনিও একটি কাজের মেয়ে খুঁজছিলেন। গত ৪ ডিসেম্বর ভবনের সিকিউরিটি গার্ড খালেকের মাধ্যমে আজিজুলের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ শুরু করেন আয়েশা। প্রতিদিন সকালে এসে ঘরের বিভিন্ন কাজ করে রাতে চলে যেতেন।

প্রতিদিনের মতো সোমবার সকাল ৭টা ৫১ মিনিটের বোরকা পরে ওই বাসায় কাজ করতে আসেন আয়েশা। এর কিছুক্ষণ আগেই অফিসের উদ্দেশে বেরিয়ে যান আজিজুল। বাসায় ছিলেন তার স্ত্রী মালাইলা আফরোজ (৪৮) ও তার মেয়ে নাফিসা বিনতে আজিজ (১৫)।

আজিজুল ইসলাম পেশায় শিক্ষক। তিনি উত্তরার সানবিমস স্কুলের পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক। সকালে স্কুলে বাচ্চাদের একটি পরীক্ষা শেষ করে সকাল সোয়া ১১টার দিকে বাসায় ফেরেন। ঘরের দরজা খুলতেই তিনি হতভম্ব হয়ে যান।

আজিজুল তার মেয়ে নাফিসা বিনতে আজিজ (১৫) রক্তাক্ত অবস্থায় ড্রইং রুমে পড়ে আছে। আর তার স্ত্রী মালাইলা আফরোজ (৪৮) বেডরুমের সামনে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। ঘরের প্রতিটি দেয়ালে রক্তের ছাপ। পুরো মেঝে রক্তে ভরা। স্ত্রীর কোনো সাড়া না পেলেও মেয়ে জীবিত আছে বলে ধারণা করেন। মেয়েকে কোলে নিয়ে লিফটে করে নিচে নামেন। এর মধ্যে বাড়ির দুজন কেয়ারটেকারও ছুটে আসেন। পরে সাড়ে ১১টার দিকে মেয়ে নাফিসাকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এরপর ঘটনাস্থলে আসেন মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। তারা আজিজুলের স্ত্রী মালাইলা আফরোজকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকেও মৃত ঘোষণা করেন। পরে ঘটনাস্থল আসেন পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট, গোয়েন্দা পুলিশ, সিআইডির ত্রাইম সিন টিম ও র‌্যাব। পুলিশ রক্তমাখা ঘরের একটি টয়লেট থেকে দুটি ধারালো ছুরি (সুইচ গিয়ার) জব্দ করে। তারা বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখেন, সকাল ৭টা ৫১ মিনিটে বোরকা পরে বাসায় আসেন গৃহকর্মী আয়েশা। পরে সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে স্কুলড্রেস পরে কাঁধে একটি ব্যাগ নিয়ে তিনি বিরেয়ে যান।

পুলিশ বলছে, সকালে গৃহকর্মী আয়েশা বাসায় ঢুকে গৃহীনী মালাইলা আফরোজ ও তার মেয়ে নাফিসা বিনতে আজিজকে হত্যা করে। হত্যার পর বাথরুমে গিয়ে গোসল করে গৃহকর্মী আয়েশা (২৩)। এরপর মেয়ে নাফিসার স্কুলড্রেস পরে বাসা থেকে বেরিয়ে যান, যাতে তাকে কেউ সন্দেহ করতে না পারে।

উত্তরার সানবিমস স্কুলের পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক এম জেড আজিজুল ইসলাম ১৩ বছর আগে এই ফ্লাটে উঠেছেন। তার স্ত্রী একজন গৃহীনী। তার মেয়ে নাফিসা মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তাদের গ্রামের বাড়ি নাটোর সদরে। সোমবার বিকেলে মা ও মেয়ের ময়নাতদন্তের পর তাদের দুজনকেই দাফনের জন্য নাটোরে নিয়ে যাওয়া হয়। মরদেহ দুটির সুরতহাল প্রতিবেদনে পুলিশ উল্লেখ করেছে, মা-মেয়ে দুজনেরই মাথা, গলা, হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছুরিকাঘাতের জখম পাওয়া গেছে।

সোমবার দুপুরে ঘটনাস্থলে সরেজমিনে পুলিশ ও নিহতের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়। বাড়ির সামনে শতাধিক মানুষের ভিড়। বাড়ির ভেতরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যরা বিভিন্নভাবে ঘটনার তদন্ত করছে। ওই বাড়ির অষ্টমতলায় গিয়ে দেখা যায়, ৭বি ফ্ল্যাটের ভেতরে র‌্যাব ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিনের সদস্যরা আলামত সংগ্রহ করছেন। ফ্ল্যাটের সামনে ও লিফটের ভেতরেও রক্তের ছাপ। পুরো ফ্ল্যাটের ভেতরটা রক্তমাখা। আসবাবপত্র এলোমেলো অবস্থায় দেখা গেছে।

বাসার ভেতরের অবস্থার বিষয়ে পুলিশ বলছে, বাসায় ধস্তাধস্তির আলামত রয়েছে, মেঝেতে ও দেয়ালে রক্তের দাগ রয়েছে। আলমারি ও ভ্যানিটি ব্যাগ তছনছ অবস্থায় রয়েছে। এ থেকে তাদের ধারণা, বাসা থেকে কিছু খোয়া যেতে পারে।

পুলিশ বলছে, হত্যাকাণ্ডের পর বাসা থেকে একটি মোবাইল ফোন ছাড়া আর কিছুই খোয়া যায়নি বলে প্রাথমিকভাবে জানা যায়। তাহলে কেন এই মা-মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে? এমন প্রশ্নে তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন চরচাকে বলেন, “প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, গৃহকর্মীর নামে কাজ নেওয়া আয়েশাই তাদের হত্যা করেছে। তবে কেন হত্যা করেছে, হত্যাকাণ্ডের মোটিভ কী–এ বিষয়ে এখনো স্পষ্ট হওয়া যায়নি। অভিযুক্ত আয়েশাকে গ্রেপ্তারের আগে এ বিষয়ে কিছুই বলা যাবে না। আমরা বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে তদন্ত করছি।”

এদিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ভবনের সিকিউরিটি গার্ড খালেককে আটক করেছে পুলিশ।

সোমবার দুপুরে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিহত নাফিসার বাবা আজিজুল ইসলাম বলেন, “আমাদের একজন গৃহকর্মীর দরকার ছিল। তাই বাসার দারোয়ানকে এমন বিষয়টা বলে রেখেছিলাম। চারদিন আগে একটি মেয়ে কাজের সন্ধানে আসে। বোরকা পরিহিত অবস্থায় ওই মেয়েটি এলে দারোয়ান তাকে আমাদের বাসায় পাঠিয়ে দেয়৷ এরপর আমার স্ত্রী মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে তাকে কাজে নেয়। পরে আমি স্ত্রীর মুখে শুনেছি, মেয়েটার নাম আয়েশা।”

আজিজুল বলেন, “মেয়েটা আমাদের জানিয়েছিল, তার গ্রামের বাড়ি রংপুর, জেনেভা ক্যাম্পে চাচা-চাচির সঙ্গে থাকেন। বাবা-মা আগুনে পুড়ে মারা গেছে, তার শরীরেও আগুনে পোড়ার ক্ষত রয়েছে। স্থায়ী গৃহকর্মী না হওয়ায় তার কোনো কাগজপত্র রাখা হয়নি। এরপর থেকে মেয়েটা সকালে আসত। আবার সন্ধ্যায় চলে যেত।”

পুলিশ জানিয়েছে, ফ্ল্যাটের ভেতরে প্রথমে মা আফরোজাকে হত্যা করে গৃহকর্মী আয়েশা। এটা দেখে মেয়ে নাফিসা দৌড়ে ইন্টারকমে সিকিউরিটি গার্ডকে ফোন দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে ইন্টারকমের লাইনটি খোলা পাওয়া যায়। পরে ড্রইং রুমেই মেয়ে নাফিসাকে হত্যা করে আয়েশা। হত্যাকারী আয়েশা ঠান্ডা মাথায় তাদের হত্যা করে পরে বাথরুমে গিয়ে গোসল করে শরীরের রক্ত পরিষ্কার করে নাফিসার স্কুলের ড্রেস পরে নির্দ্বিধায় গেট দিয়ে বেরিয়ে যায়।

তল্লাশি করে বাথরুমে একটি সুইচ গিয়ার ও একটি ধারালো অস্ত্র পাওয়া যায়। ধারণা করা হচ্ছে, ওই ছুরি দুটি দিয়ে মা-মেয়েকে হত্যা করেছে গৃহকর্মী আয়েশা। এ ঘটনায় ওই বাসার দারোয়ান খালেককে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।

নিহত নাফিসার মামা ও আফরোজার বড় ভাই বাবু চরচাকে বলেন, “আমার বোন বা বোন জামাইয়ের সঙ্গে কারও কোনো বিরোধ নেই। তারা নির্ভেজাল মানুষ। বোন বাসায় থাকেন। তিনি শুধু মেয়েকে স্কুলে আনা-নেওয়া করেন। আমাদের ধারণা ঘরে চুরির উদ্দেশে গৃহকর্মী সেজে বাসায় ঢুকে বোন ও ভাগ্নিকে হত্যা করা হয়েছে। বাসা থেকে অনেক কিছু চুরিও হয়েছে।”

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার ইবনে মিজান বলেন, “মা-মেয়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমরা কিছু তথ্য পেয়েছি। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। তদন্ত চলছে। অভিযুক্তকে দ্রুত গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তাকের পেলেই হত্যাকাণ্ডের মোটিভ জানা যাবে।”

সম্পর্কিত