কোথাও ‘শান্তি নেই’, এই ৫ দেশে আছে কীভাবে

চরচা ডেস্ক
চরচা ডেস্ক
কোথাও ‘শান্তি নেই’, এই ৫ দেশে আছে কীভাবে
আইসল্যান্ড। ছবি: রয়টার্স

বিভিন্ন কারণে এ বছর ‘শান্তি’ যেন এক অধরা বস্তুতে পরিণত হয়েছে। ২০২৫ সালের গ্লোবাল পিস ইনডেক্স (জিপিআই) অনুযায়ী, রাষ্ট্রভিত্তিক দ্বন্দ্ব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। আর এরই জেরে কেবল এ বছরই নতুন তিনটি দেশ সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় অনেক দেশ তাদের সামরিক ব্যবস্থা সমৃদ্ধ করেছে।

তবে এর মাঝেও কিছু দেশ শান্তি সূচকে বেশ ভালো অবস্থানে আছে। ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড পিস প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিপিআই ২৩টি সূচক ব্যবহার করে। এর মধ্যে রয়েছে বহিঃসংঘর্ষ ও সামরিক ব্যয় থেকে শুরু করে সন্ত্রাসবাদ ও হত্যার মতো নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সম্পর্কিত বিভিন্ন মাপকাঠি। বিগত দুই দশক ধরে এই সূচকের শীর্ষে থাকা দেশগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে।

এই প্রতিবেদনের জন্য বিবিসি বিশ্বের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ কয়েকটি দেশের নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলেছে। তারা এটা জানতে চেয়েছে যে, এসব নীতি তাদের দৈনন্দিন জীবনে কতটুকু প্রভাব ফেলে এবং সেগুলো কীভাবে তাদের সুররক্ষিত ভাবায়।

তালিকার শীর্ষ দশটি দেশের মধ্যে আটটিই ইউরোপের। বাকি দুইটি দেশের মধ্যে একটি এশিয়ার ও অপরটি ওশেনিয়া মহাদেশের।

আইসল্যান্ড

২০০৮ সাল থেকে আইসল্যান্ড শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। নিরাপত্তা ও সুরক্ষা, চলমান সংঘর্ষ এবং সামরিকীকরণ- এই তিনটি ক্ষেত্রে দেশটির অবস্থান প্রথম।

ইনগা রোস আন্তোনিউদোত্তির ইন্ট্রেপিড ট্রাভেল নর্থ ইউরোপের জেনারেল ম্যানেজার। তিনি বলেন, “রাতেও আপনি একা নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াতে পারেন। শিশুরা ক্যাফে ও দোকানের বাইরে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে, তাদের বাবা-মা খাবার খাচ্ছেন বা প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নিচ্ছেন। স্থানীয় পুলিশ কোনো অস্ত্র বহন করে না।”

দেশের লিঙ্গ সমতা নীতি নারীদের নিরাপত্তাবোধের মূল কারণ হিসেবে দেখেন ইনগা। অন্য দেশ থেকে আইসল্যান্ডে যারা বেড়াতে আসেন, তাদেরকে স্থানীয়দের দৈনন্দিন অভ্যাসে যোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

ইনগা বলেন, “পুলে সাঁতার কাটুন অথবা অপরিচিতদের সঙ্গে গল্প করুন। পাহাড়ে হাঁটতে চলে যান, চাইলে রিকজাভিকের বাইরে উঁচু ভূমিতে হাইক করতে পারেন।”

আয়ারল্যান্ড

বিংশ শতকে আয়ারল্যান্ড সংঘাতময় পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গেলেও আধুনিক আয়ারল্যান্ড এখন শান্তিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। সামরিকীকরণ হ্রাস করার জন্য দেশটি সবচেয়ে বেশি স্কোর পেয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষার ক্ষেত্রেও এটি শীর্ষ ১০-এর মধ্যে রয়েছে, যেখানে অপরাধ ও সহিংসতার হার খুবই কম।

দেশটির কিলকিয়া ক্যাসলের পরিচালক জ্যাক ফিটজসিমনস বলেন, “এটা এমন এক জায়গা, যেখানে আপনি অপরিচিত কারো কাছে সাহায্য চাইলে তারা অবশ্যই এগিয়ে আসবে।”

ইউরোপের যে চারটি দেশ ন্যাটোর সদস্য নয়, আয়ারল্যান্ড তাদের একটি। সমস্যার সমাধানের জন্য আয়ারল্যান্ড কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ওপর জোর দেয়। প্রাকৃতিক দৃশ্য ও সাংস্কৃতিক স্থান সংরক্ষণকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় এবং ভ্রমণকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আয়ারল্যান্ডের প্রশাসন।

ফিটজসিমনস বিবিসিকে বলেন, ‘‘এটা ভাবতে ভালো লাগে যে, অতিথিরা আইরিশদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ দেখে কতটা বিস্মিত হন। বিদেশি ভ্রমণকারীদের যথাযথ আতিথেয়তা প্রদান আমাদের সংস্কৃতির অংশ।’’

আয়ারল্যান্ডের প্রকৃতিও শান্তির অনুভূতি তৈরি করে। ফিটজসিমনস বলেন, “এখানে জীবন একটু ধীরগতিতে চললেও মানুষ এখনও পারস্পরিক আলাপ বা যোগাযোগকে মূল্য দেয়।”

নিউজিল্যান্ড

শান্তি সূচকে গত বছর নিউজিল্যান্ডের অবস্থান ছিল পঞ্চম। নিরাপত্তা ও সুরক্ষার ক্ষেত্রে উন্নতি এবং বিক্ষোভ ও সন্ত্রাসবাদ-সম্পর্কিত ঘটনা হ্রাসের কারণে এ বছর দুই ধাপ উন্নতি হয়েছে।

ভৌগোলিক অবস্থান নিউজিল্যান্ডকে বাইরের সংঘাত থেকে স্বাভাবিকভাবে সুরক্ষা দেয়। তবে অভ্যন্তরীণ নীতিমালাও দেশের নাগরিকদের অনুকূল।

গ্রিনার প্যাস্টারস নামের রিলোকেশন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মিশা বলেন, “নিউজিল্যান্ডের অস্ত্র আইন বিশ্বের অন্যতম কঠোর, যা নিঃসন্দেহে নিরাপত্তাবোধ বৃদ্ধি করে। এটি এমন একটি দেশ যেখানে শিশুরা একাকী স্কুলে যায়, মানুষ দরজা খোলা রাখে, আর রাস্তায় কোনো গাড়ি নষ্ট হলে মোটরচালকেরা থেমে সাহায্য করে।’’

সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা ও সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি, প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগকেও নিউজিল্যান্ডবাসী গুরুত্ব দেয়। এখানে সব বয়সের জন্য বিভিন্ন উৎসব ও অনুষ্ঠান হয়, যা পরিবারের মধ্যে সম্পর্ককে দৃঢ় করে। অনেক ভ্রমণকারী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য এখানে এলেও, শেষ পর্যন্ত তারা এখানকার মানুষের আন্তরিকতা মনে রাখে। “নিউজিল্যান্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চেয়ে আসল শক্তি হলো এখানকার মানুষ,” বলেন মিশা।

অস্ট্রিয়া

এ বছর অস্ট্রিয়া এক ধাপ পিছিয়ে চতুর্থ স্থানে নেমে এলেও সব সূচকেই ভালো অবস্থান ধরে রেখেছে। অস্ট্রিয়া সাংবিধানিকভাবে নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে। এর ফলে দেশটি অভ্যন্তরীণ উন্নয়নেই সম্পদ ও মনোযোগ দিতে পারে।

দেশটির হোটেল জাগদফের মালিক আরমিন ফুর্টশেলার বলেন, ‘‘অস্ট্রিয়া সংঘাতের বদলে নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বারোপ করে। শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থা, বিশ্বমানের স্বাস্থ্যসেবা এবং উৎকৃষ্ট শিক্ষা নাগরিকদের জীবনে স্থিতিশীলতা তৈরি করে।’’

তিনি যেখানে থাকেন, সেখানে মানুষজন রাতদুপুরে নদীর ধারে হাঁটে, ঘরবাড়িতে তালা দেওয়া থাকে না এবং ক্যাফের বাইরে সাইকেল রাখা যায় শিকল ছাড়াই।

আরমিন বলেন, “এখানে যারা বেড়াতে আসেন, কয়েক দিনের মধ্যেই তাদের মানসিক চাপ দূর হয়ে যায়। এখানকার বিশেষত্ব হলো, এখানে আপনি শুধু নিজের মতো করেই থাকতে পারেন।”

সিঙ্গাপুর

শীর্ষ দশে থাকা এশিয়ার একমাত্র দেশ সিঙ্গাপুর। চলমান কোনো সংঘাত না থাকায় এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাব্যবস্থা শক্তিশালী হওয়ায় অধিকাংশ নাগরিক নিরাপত্তা অনুভব করে। “গভীর রাতে হাঁটতে বের হলেও আমি ভয় পাই না। রাতে হেঁটে বাড়ি ফেরা বেশিরভাগ বড় শহরের মতো উদ্বেগজনক নয়,” বলেন এখানকার একজন জিনরুন হান। তিনি বলেন, “প্রশাসনের প্রতি আমার প্রতি শতভাগ আস্থা রয়েছে, যারা নিরাপদ পরিবেশ তৈরিতে অনেক যত্নবান।”

হান দর্শনার্থীদের পরামর্শ দেন, সিঙ্গাপুরের স্বাধীনতাগুলো উপভোগ করার জন্য। যেমন মধ্যরাতে নদীর ধারে হাঁটা, রাতের বেলা স্ট্রিট ফুড খাওয়া বা অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পরেও পার্কে ভ্রমণ। তিনি বলেন, “সবকিছুই খুব মুক্ত মনে হয় এখানে, তা আপনি ভ্রমণেই এসে থাকুন বা এখানকার স্থানীয় কেউ হন।”

সম্পর্কিত