স্থিতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক খাত কীভাবে পাবে বাংলাদেশ

চরচা ডেস্ক
চরচা ডেস্ক
স্থিতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক খাত কীভাবে পাবে বাংলাদেশ
বাংলাদেশ ব্যাংক। ছবি: বাসস

সাম্প্রতিক কয়েক বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অনেকটাই থমকে গেছে। সেইসঙ্গে ক্রমাগত অর্থপাচার দেশের আর্থিক খাতে ব্যাপক চাপ তৈরি করেছে। এ পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে- শক্তিশালী ও জবাবদিহিমূলক আর্থিক খাত ছাড়া কি বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে পারবে?

বিষয়টি নিয়ে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ব্লগে লিখেছেন বিশ্বব্যাংকের ভুটান ও বাংলাদেশের জন্য ডিভিশন ডিরেক্টর জ্যঁ পেম। তার মতে, উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হতে হলে বাংলাদেশের প্রয়োজন ব্যাপক বিনিয়োগ ও বেসরকারি পুঁজির সংস্থান। কিন্তু বাস্তবে দেশটির আর্থিক খাত এখনও তুলনামূলকভাবে বেশ দুর্বল।

বাংলাদেশের মোট আর্থিক খাতের ৮৮ শতাংশ রয়েছে ব্যাংকিং খাতের অধীনে। আর এই খাতটি এই মুহূর্তে রয়েছে চরম চাপের মুখে। বছরের পর বছর দুর্বল করপোরেট শাসন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার উদাসীনতা এবং নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর মধ্যে ঋণ বিতরণের চর্চা ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। এ জন্য ব্যাংক থেকে প্রচুর অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে।

পরিস্থিতি উন্নয়নে স্বচ্ছতা ও তথ্য প্রকাশ বাড়াতে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নীতিমালা সংস্কার এবং তদারকি জোরদার করেছে অন্তর্বর্তী সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক।

ব্যাংকিং খাত সংস্কারের লক্ষ্যে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে আর্থিক খাত বিষয়ে অভিজ্ঞ ছয়জনকে সদস্য করা হয়েছে।

জ্যঁ পেম মনে করেন, এসব উদ্যোগে দীর্ঘদিনের কাঠামোগত দুর্বলতা ও অতীতের অপশাসনের চিত্র স্পষ্ট হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো উচ্চ খেলাপি ঋণ ও তীব্র মূলধন সংকটে ভুগছে, ফলে ব্যাংক খাতের পুনর্গঠন অনিবার্য।

আর্থিক স্থিতিশীলতা ফেরানোর চ্যালেঞ্জ

ব্যাংকিং ব্যবস্থা পুনর্গঠনে জিডিপির অন্তত ১০ শতাংশ সমপরিমাণ অর্থ পুনঃমূলধন হিসেবে প্রয়োজন হবে। এতে রাজস্বের ওপর বাড়তি চাপ বাড়বে, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ সংকুচিত হবে এবং সরকার ও ব্যাংক সম্পর্ক আরও জটিল হয়ে উঠবে।

বিশ্বব্যাংকের ভুটান ও বাংলাদেশের জন্য ডিভিশন ডিরেক্টর জ্যঁ পেম। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া
বিশ্বব্যাংকের ভুটান ও বাংলাদেশের জন্য ডিভিশন ডিরেক্টর জ্যঁ পেম। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

২০২৫ অর্থবছর শেষে মোট সরকারি ঋণের ৩৬ দশমিক ১ শতাংশই ছিল দেশীয় ব্যাংকের হাতে, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৩৪ দশমিক ৭ শতাংশ। আগামী বাজেটে সরকারের মোট ঋণের ৪৭ শতাংশই ব্যাংক খাত থেকে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। দেরি করলে ব্যয় ও ঝুঁকি দুটোই বাড়বে।

বিশ্বব্যাপী অভিজ্ঞতা বলছে, ব্যাংকিং সংকট অর্থনীতির জন্য বড় ধাক্কা। সরকার ও ব্যাংক- উভয়ই সংকটে পড়লে এর প্রভাব সবচেয়ে ভয়াবহ হয়। বিশ্বব্যাংকের (২০২৪) তথ্য অনুযায়ী, এমন পরিস্থিতিতে সংকট শুরুর এক বছরের মধ্যে মাথাপিছু প্রকৃত জিডিপি গড়ে ৭ শতাংশ কমে যায়।

বাংলাদেশের বাস্তবতা আলাদা হলেও এসব শিক্ষা প্রাসঙ্গিক। সুশাসিত ব্যাংকিং ব্যবস্থা বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে, খেলাপি ঋণ কমাবে এবং বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ পুনরুজ্জীবিত করবে, যা কর্মসংস্থান ও আয় বাড়াবে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ উদ্ধারের চেষ্টাও চলছে।

চারটি অগ্রাধিকার

সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও আর্থিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে চারটি বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের এই ডিভিশন ডিরেক্টর।

প্রথমত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যকর স্বাধীনতা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে সুরক্ষার পূর্বশর্ত। তবে আইন থাকলেই চলবে না, প্রয়োজন নিয়মকানুনের কঠোর প্রয়োগ ও ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি।

দ্বিতীয়ত, ব্যাংক পুনর্গঠনকে টেকসই করা ও লাভজনকতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, স্বচ্ছভাবে দায় ভাগাভাগি নিশ্চিত করতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ জরুরি। আদালতের স্থবির প্রক্রিয়াসহ আইনি ও বাজারের দুর্বলতা দূর করে দেউলিয়া আইন শক্তিশালী করা এবং খেলাপি ঋণ কেনাবেচার জন্য সেকেন্ডারি মার্কেট ব্যবস্থা গড়তে হবে।

তৃতীয়ত, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সংস্কারের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান (এসএমই), নারী ও যুব উদ্যোক্তাদের জন্য বাণিজ্যিক অর্থায়ন বাড়াতে হবে। সম্পদের মান পর্যালোচনার মাধ্যমে সময়সীমাভিত্তিক সংস্কার কৌশল গ্রহণ করে সুশাসন ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে।

চতুর্থত, নতুন আমানত সুরক্ষা অধ্যাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা যথেষ্ট নয়। এর পূর্ণ বাস্তবায়ন, তহবিল সম্প্রসারণ ও জনসচেতনতা বাড়ানো জরুরি।

আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও অর্থায়ন প্রসার

জ্যঁ পেম মনে করেন, এক দশকের অগ্রগতির পর বাংলাদেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির গতি থমকে গেছে, বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে। বর্তমানে প্রাপ্তবয়স্কদের অর্ধেকের একটু বেশি ব্যাংক হিসাব বা মোবাইল মানির সুবিধা পান, আর নারী-পুরুষ ব্যবধান বিশ্বের অন্য যেকোনো জায়গার থেকে বেশি। ব্যবসার জন্য অর্থায়নে প্রবেশাধিকারও বড় বাধা। আর্থিক খাত স্থিতিশীল না হলে অন্তর্ভুক্তি বাড়ানোর উদ্যোগ সফল হবে না।

জ্যঁ পেমের পরামর্শ, ডিজিটাল অর্থায়ন জোরদার করতে মোবাইল আর্থিক সেবাকে মার্চেন্ট ই-ওয়ালেট ইস্যু ও যাচাইয়ের সুযোগ দেওয়া, ফি ও মূল্য নির্ধারণে স্বচ্ছতা বাড়ানো এবং ক্রেডিট তথ্য ব্যুরোর ডেটা সম্প্রসারণের ওপর জোর দেওয়া যেতে পারে।

সবশেষে আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা কেবল কারিগরি লক্ষ্য নয়, এটাই অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ভিত্তি। শক্তিশালী ও জবাবদিহিমূলক আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি ও মানসম্মত কর্মসংস্থানের পথে এগোতে পারবে।

সম্পর্কিত