জ্যঁ পেম

চাকরি বা কর্মসংস্থান কেবল অর্থ উপার্জন বা দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার উপায় নয়, এটি মানুষকে সম্মানও এনে দেয়। ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ১ কোটি ৪০ লাখ তরুণ-তরুণী কর্মক্ষম বয়সে পৌঁছালেও এই সময়ে শ্রমবাজারে যুক্ত হয়েছে মাত্র ৮৭ লাখ নতুন চাকরি। তার মানে প্রায় অর্ধেক তরুণ এই সময়ে কর্মসংস্থান পায়নি। যারা চাকরি পেয়েছে, তাদের প্রায় ৭০ শতাংশই যুক্ত হয়েছে স্বল্প উৎপাদনশীল কৃষিখাতে। একই সময়ে উৎপাদন (ম্যানুফ্যাকচারিং) খাতে কর্মসংস্থান কমেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। দেশের তরুণ ও ক্রমবর্ধমান শ্রমশক্তি বাংলাদেশকে একটি জনমিতিক সুবিধা দিচ্ছে। তবে এই সুযোগের সময়সীমা সীমিত। কারণ এটি ২০৩০-এর দশকের শেষভাগ পর্যন্ত চলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের উৎপাদন খাত তুলনামূলকভাবে ভালো বেতনের চাকরি দেয়। তবে ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে খাতটি বছরে গড়ে প্রায় ৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেলেও এতে কর্মসংস্থান প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে। এর সম্ভাব্য কারণ হিসেবে স্বয়ংক্রিয়তা বৃদ্ধি, মূলধনী বিনিয়োগ এবং তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতার কথা বলা হচ্ছে।
দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮২ শতাংশ আসে আরএমজি খাত থেকে, কিন্তু জাতীয় কর্মসংস্থানে এ খাতের অবদান মাত্র প্রায় ৬ শতাংশ। তাই সহজেই ধারণা করা যায়, রপ্তানি সাফল্য যথেষ্ট কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারেনি। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের পর উৎপাদন খাতের রপ্তানি, বিশেষ করে পোশাকশিল্প, আরও কঠিন বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিবেশের মুখে পড়বে।
বাংলাদেশের উচিত আরও বেশি কর্মসংস্থান ও ভালো বেতনে চাকরির সুযোগ তৈরি করা। উচ্চ বেতন, উৎপাদনশীলতা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে এমন ভালো মানের চাকরি দীর্ঘমেয়াদি সমৃদ্ধির ভিত্তি গড়ে তোলে। শ্রমিকরা যখন কৃষির মতো স্বল্প উৎপাদনশীল কাজ থেকে উৎপাদন ও সেবা খাতের বেশি পারিশ্রমিকের কাজে যুক্ত হয়, তখন আয় বাড়ে, মানুষের জীবনমান বদলায় এবং অর্থনীতি আরও স্থিতিশীল হয়। সেইসঙ্গে সমাজে তাদের মর্যাদাও সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশে নারী ও তরুণদের জন্য শ্রমবাজারে প্রবেশ আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং। তরুণদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ কমেছে। ২০২৩ সালে তরুণদের বেকারত্বের হার ছিল ৮ শতাংশ, আর বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া তরুণদের মধ্যে তা ছিল ১৪ শতাংশ। এ ছাড়া, ১৬ শতাংশ তরুণ কর্মসংস্থান, শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের বাইরে। এর মধ্যে ৭৩ শতাংশই নারী এবং ৬৩ শতাংশ শহরের তরুণ-তরুণী

বাংলাদেশে কর্মসংস্থানে প্রবেশে সবচেয়ে বেশি বাধার মুখে পড়েন নারীরা। প্রতি পাঁচজন তরুণীর একজন কোনো কাজে যুক্ত নন, আর শিক্ষিত তরুণীদের ক্ষেত্রে এই হার প্রতি চারজনে একজন। শহরে শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ ২০১৬ সালের ৩১ শতাংশ থেকে ২০২৩ সালে কমে ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। অনেক নারী কৃষিখাতে চলে গেছেন, যেখানে তারা মূলত স্বল্প বেতনের অনানুষ্ঠানিক কাজে যুক্ত।
বর্তমানে কৃষিখাতে কর্মরত শ্রমিকদের ৫৮ শতাংশই নারী। বিপরীতে, উৎপাদন খাতে নারীদের অংশগ্রহণ কমেছে, যা আরএমজি সেক্টরের শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণের আগের অগ্রগতির চিত্র একদম উল্টে দিয়েছে।
নারীরা কেন কর্মক্ষেত্র ছাড়ছেন- তা বোঝার জন্য আরও গভীর বিশ্লেষণ প্রয়োজন। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে পেছনে ফেলে রেখে কোনো দেশই সমৃদ্ধ হতে পারে না।
বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরও দ্রুততর করতে হবে। সেই প্রবৃদ্ধিকে স্থিতিশীল ও উন্নতমানের কর্মসংস্থানে রূপান্তর করতে হবে, যা মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করবে। এ লক্ষ্য অর্জনে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পথে থাকা তিনটি বড় বাধা মোকাবিলা করতে হবে। এগুলো হলো-অবকাঠামোগত ঘাটতি, দক্ষতার ঘাটতি এবং নিয়ন্ত্রক ঘাটতি।
অবকাঠামো ঘাটতির মূল কারণ দ্রুত নগরায়ণ। এই ঘাটতি কমাতে হলে শিল্প সম্প্রসারণ ও অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য আনতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় ভৌত ও ডিজিটাল অবকাঠামোতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি ও ইউটিলিটি সেবা, আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা এবং ডিজিটাল সংযোগ ব্যবসায়িক ব্যয় কমাতে ও বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম শিল্প করিডরের বাইরে শহর ও গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এসব অবকাঠামোর ভূমিকা অপরিহার্য। বিপুল বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় সরকারি অর্থায়নের পাশাপাশি বেসরকারি অর্থায়ন বাড়ানোও জরুরি।
শ্রমবাজারে চাহিদাসম্পন্ন দক্ষতা এবং কর্মীদের বিদ্যমান দক্ষতার মধ্যে অসামঞ্জস্যের কারণে দক্ষতার ঘাটতি তৈরি হয়েছে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা অনেক সময়ই শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এসব ব্যবস্থাকে আরও বাজারভিত্তিক ও কর্মসংস্থানমুখী করতে হবে।

শিল্পখাত ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সহযোগিতা জোরদার, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার সম্প্রসারণ এবং শিক্ষানবিশ কর্মসূচি বিস্তারের মাধ্যমে শিক্ষা যেন বাস্তব কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নারী ও তরুণদের জন্য লক্ষ্যভিত্তিক কর্মসূচি দ্রুত ডেভেলপমেন্ট সেক্টরে তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে সহায়ক হতে পারে। স্বল্পমেয়াদি এই উদ্যোগগুলোর পাশাপাশি মানবসম্পদ উন্নয়ন ও শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতেও জোর দিতে হবে।
ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (এমএসএমই) জন্য ব্যবসা পরিচালনার উচ্চ ব্যয়ের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক ঘাটতির প্রতিফলন দেখা যায়। এটি ব্যবসা সম্প্রসারণ ও নতুন কর্মী নিয়োগে বাধা সৃষ্টি করে। এই ঘাটতি দূর করা জরুরি, যাতে তৈরি পোশাক শিল্পের বাইরে আইটি সেবা, লজিস্টিকস ও কৃষি-প্রক্রিয়াজাতকরণের মতো নতুন খাতে প্রবৃদ্ধির চালিকা শক্তি তৈরি হয়। এতে রপ্তানি খাত আরও গতিশীল হবে এবং উন্নতমানের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা কমানো, বিধিবিধান সহজ করা, দুর্নীতি ও হয়রানি দূর করা, লজিস্টিক ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং এমএসএমই খাতে ঋণ পাওয়া সহজ করার মাধ্যমে বিনিয়োগ ও উদ্ভাবন বাড়ানো সম্ভব।
বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে হবে। নারীদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশে বহুমুখী সমস্যা রয়েছে। শিক্ষা ও মজুরিতে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য, শিশুদের যত্নের সুবিধার অভাব, অনিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা এবং সামাজিক রীতিনীতি নারীর চলাচল সীমিত করে ও বাল্যবিবাহকে উৎসাহিত করে। এসব সমাধানে নানা কৌশল প্রয়োজন।
তার পরামর্শ, অধিক উৎপাদনশীল ও ভালো বেতনের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাংলাদেশকে সাহসী ও জরুরি সংস্কারের পথে এগোতে হবে। এজন্য কার্যকর নীতি ও নিয়ন্ত্রক সংস্কারের মাধ্যমে বেসরকারি খাতকে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ করে দিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা, সমান সুযোগের ক্ষেত্র তৈরি করা, স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন করব্যবস্থা, সুশাসন এবং জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
লেখক: বাংলাদেশ ও ভুটানের জন্য বিশ্বব্যাংকের বিভাগীয় পরিচালক

চাকরি বা কর্মসংস্থান কেবল অর্থ উপার্জন বা দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার উপায় নয়, এটি মানুষকে সম্মানও এনে দেয়। ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ১ কোটি ৪০ লাখ তরুণ-তরুণী কর্মক্ষম বয়সে পৌঁছালেও এই সময়ে শ্রমবাজারে যুক্ত হয়েছে মাত্র ৮৭ লাখ নতুন চাকরি। তার মানে প্রায় অর্ধেক তরুণ এই সময়ে কর্মসংস্থান পায়নি। যারা চাকরি পেয়েছে, তাদের প্রায় ৭০ শতাংশই যুক্ত হয়েছে স্বল্প উৎপাদনশীল কৃষিখাতে। একই সময়ে উৎপাদন (ম্যানুফ্যাকচারিং) খাতে কর্মসংস্থান কমেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। দেশের তরুণ ও ক্রমবর্ধমান শ্রমশক্তি বাংলাদেশকে একটি জনমিতিক সুবিধা দিচ্ছে। তবে এই সুযোগের সময়সীমা সীমিত। কারণ এটি ২০৩০-এর দশকের শেষভাগ পর্যন্ত চলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের উৎপাদন খাত তুলনামূলকভাবে ভালো বেতনের চাকরি দেয়। তবে ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে খাতটি বছরে গড়ে প্রায় ৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেলেও এতে কর্মসংস্থান প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে। এর সম্ভাব্য কারণ হিসেবে স্বয়ংক্রিয়তা বৃদ্ধি, মূলধনী বিনিয়োগ এবং তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতার কথা বলা হচ্ছে।
দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮২ শতাংশ আসে আরএমজি খাত থেকে, কিন্তু জাতীয় কর্মসংস্থানে এ খাতের অবদান মাত্র প্রায় ৬ শতাংশ। তাই সহজেই ধারণা করা যায়, রপ্তানি সাফল্য যথেষ্ট কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারেনি। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের পর উৎপাদন খাতের রপ্তানি, বিশেষ করে পোশাকশিল্প, আরও কঠিন বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিবেশের মুখে পড়বে।
বাংলাদেশের উচিত আরও বেশি কর্মসংস্থান ও ভালো বেতনে চাকরির সুযোগ তৈরি করা। উচ্চ বেতন, উৎপাদনশীলতা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে এমন ভালো মানের চাকরি দীর্ঘমেয়াদি সমৃদ্ধির ভিত্তি গড়ে তোলে। শ্রমিকরা যখন কৃষির মতো স্বল্প উৎপাদনশীল কাজ থেকে উৎপাদন ও সেবা খাতের বেশি পারিশ্রমিকের কাজে যুক্ত হয়, তখন আয় বাড়ে, মানুষের জীবনমান বদলায় এবং অর্থনীতি আরও স্থিতিশীল হয়। সেইসঙ্গে সমাজে তাদের মর্যাদাও সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশে নারী ও তরুণদের জন্য শ্রমবাজারে প্রবেশ আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং। তরুণদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ কমেছে। ২০২৩ সালে তরুণদের বেকারত্বের হার ছিল ৮ শতাংশ, আর বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া তরুণদের মধ্যে তা ছিল ১৪ শতাংশ। এ ছাড়া, ১৬ শতাংশ তরুণ কর্মসংস্থান, শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের বাইরে। এর মধ্যে ৭৩ শতাংশই নারী এবং ৬৩ শতাংশ শহরের তরুণ-তরুণী

বাংলাদেশে কর্মসংস্থানে প্রবেশে সবচেয়ে বেশি বাধার মুখে পড়েন নারীরা। প্রতি পাঁচজন তরুণীর একজন কোনো কাজে যুক্ত নন, আর শিক্ষিত তরুণীদের ক্ষেত্রে এই হার প্রতি চারজনে একজন। শহরে শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ ২০১৬ সালের ৩১ শতাংশ থেকে ২০২৩ সালে কমে ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। অনেক নারী কৃষিখাতে চলে গেছেন, যেখানে তারা মূলত স্বল্প বেতনের অনানুষ্ঠানিক কাজে যুক্ত।
বর্তমানে কৃষিখাতে কর্মরত শ্রমিকদের ৫৮ শতাংশই নারী। বিপরীতে, উৎপাদন খাতে নারীদের অংশগ্রহণ কমেছে, যা আরএমজি সেক্টরের শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণের আগের অগ্রগতির চিত্র একদম উল্টে দিয়েছে।
নারীরা কেন কর্মক্ষেত্র ছাড়ছেন- তা বোঝার জন্য আরও গভীর বিশ্লেষণ প্রয়োজন। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে পেছনে ফেলে রেখে কোনো দেশই সমৃদ্ধ হতে পারে না।
বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরও দ্রুততর করতে হবে। সেই প্রবৃদ্ধিকে স্থিতিশীল ও উন্নতমানের কর্মসংস্থানে রূপান্তর করতে হবে, যা মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করবে। এ লক্ষ্য অর্জনে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পথে থাকা তিনটি বড় বাধা মোকাবিলা করতে হবে। এগুলো হলো-অবকাঠামোগত ঘাটতি, দক্ষতার ঘাটতি এবং নিয়ন্ত্রক ঘাটতি।
অবকাঠামো ঘাটতির মূল কারণ দ্রুত নগরায়ণ। এই ঘাটতি কমাতে হলে শিল্প সম্প্রসারণ ও অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য আনতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় ভৌত ও ডিজিটাল অবকাঠামোতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি ও ইউটিলিটি সেবা, আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা এবং ডিজিটাল সংযোগ ব্যবসায়িক ব্যয় কমাতে ও বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম শিল্প করিডরের বাইরে শহর ও গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এসব অবকাঠামোর ভূমিকা অপরিহার্য। বিপুল বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় সরকারি অর্থায়নের পাশাপাশি বেসরকারি অর্থায়ন বাড়ানোও জরুরি।
শ্রমবাজারে চাহিদাসম্পন্ন দক্ষতা এবং কর্মীদের বিদ্যমান দক্ষতার মধ্যে অসামঞ্জস্যের কারণে দক্ষতার ঘাটতি তৈরি হয়েছে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা অনেক সময়ই শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এসব ব্যবস্থাকে আরও বাজারভিত্তিক ও কর্মসংস্থানমুখী করতে হবে।

শিল্পখাত ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সহযোগিতা জোরদার, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার সম্প্রসারণ এবং শিক্ষানবিশ কর্মসূচি বিস্তারের মাধ্যমে শিক্ষা যেন বাস্তব কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নারী ও তরুণদের জন্য লক্ষ্যভিত্তিক কর্মসূচি দ্রুত ডেভেলপমেন্ট সেক্টরে তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে সহায়ক হতে পারে। স্বল্পমেয়াদি এই উদ্যোগগুলোর পাশাপাশি মানবসম্পদ উন্নয়ন ও শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতেও জোর দিতে হবে।
ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (এমএসএমই) জন্য ব্যবসা পরিচালনার উচ্চ ব্যয়ের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক ঘাটতির প্রতিফলন দেখা যায়। এটি ব্যবসা সম্প্রসারণ ও নতুন কর্মী নিয়োগে বাধা সৃষ্টি করে। এই ঘাটতি দূর করা জরুরি, যাতে তৈরি পোশাক শিল্পের বাইরে আইটি সেবা, লজিস্টিকস ও কৃষি-প্রক্রিয়াজাতকরণের মতো নতুন খাতে প্রবৃদ্ধির চালিকা শক্তি তৈরি হয়। এতে রপ্তানি খাত আরও গতিশীল হবে এবং উন্নতমানের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা কমানো, বিধিবিধান সহজ করা, দুর্নীতি ও হয়রানি দূর করা, লজিস্টিক ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং এমএসএমই খাতে ঋণ পাওয়া সহজ করার মাধ্যমে বিনিয়োগ ও উদ্ভাবন বাড়ানো সম্ভব।
বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে হবে। নারীদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশে বহুমুখী সমস্যা রয়েছে। শিক্ষা ও মজুরিতে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য, শিশুদের যত্নের সুবিধার অভাব, অনিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা এবং সামাজিক রীতিনীতি নারীর চলাচল সীমিত করে ও বাল্যবিবাহকে উৎসাহিত করে। এসব সমাধানে নানা কৌশল প্রয়োজন।
তার পরামর্শ, অধিক উৎপাদনশীল ও ভালো বেতনের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাংলাদেশকে সাহসী ও জরুরি সংস্কারের পথে এগোতে হবে। এজন্য কার্যকর নীতি ও নিয়ন্ত্রক সংস্কারের মাধ্যমে বেসরকারি খাতকে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ করে দিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা, সমান সুযোগের ক্ষেত্র তৈরি করা, স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন করব্যবস্থা, সুশাসন এবং জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
লেখক: বাংলাদেশ ও ভুটানের জন্য বিশ্বব্যাংকের বিভাগীয় পরিচালক