দ্য ডিপ্লোম্যাটের নিবন্ধ
বাহাউদ্দিন ফয়জী

বাংলাদেশ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং রাষ্ট্রীয় সংস্কারের ওপর গণভোটের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ২০২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনের কথা রয়েছে। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি টার্নিং পয়েন্ট।
এই ভোট অনুষ্ঠিত হবে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে হওয়া ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিশাল গণ-আন্দোলনের দেড় বছর পার হওয়ার পর। ওই আন্দোলনের ফলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। এখন তিনি ভারতে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দেশকে এখন প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় সংস্কারের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারকেও সংস্কার বিলম্বের কারণে নতুন করে বিক্ষোভের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে গভীর বিভক্তি দেখা দিয়েছিল। কয়েক মাস ধরে মুহাম্মদ ইউনূস কোনো নির্দিষ্ট সময়সূচি দিতে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন, যা কিছু রাজনৈতিক দলের মধ্যে ক্ষোভ বাড়িয়ে তুলছিল। অবশেষে ইউনূস ২০২৬ সালের জুন মাসে নির্বাচনের ঘোষণা দেন। কিন্তু ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে তিনি প্রথমে নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তন করে এপ্রিলে আনেন এবং শেষ পর্যন্ত তা আরও কমিয়ে ফেব্রুয়ারিতে নিয়ে আসেন।
এই নির্বাচন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ভোটারা শুধু নতুন আইনপ্রণেতা নির্বাচন করবেন না, একই সঙ্গে ‘জুলাই সনদ’ নামের প্রস্তাবিত সংস্কার প্যাকেজের ওপর গণভোটেও অংশ নেবেন। ২০২৪ সালের গণ-আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি এই রাষ্ট্রীয় সংস্কার পরিকল্পনায়—নির্বাহী ক্ষমতা সংকোচন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা জোরদার এবং নির্বাচন কমিশনসহ গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বায়ত্তশাসন বৃদ্ধির মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব রয়েছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপব্যবহার রোধ করার লক্ষ্যও এতে অন্তর্ভুক্ত।
উদ্দেশ্য হলো ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের দাবিগুলো পূরণ করে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা ও ক্ষমতাকে জবাবদিহিমূলক করে তোলা। কিন্তু গণভোটটি নিজেই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
২০২৬ সালের সাধারণ নির্বাচন অন্তর্বর্তী প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে একটি নতুন ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত হবে। ৩০০টি নির্বাচনী এলাকায় প্রায় ১২ কোটি ৭৬ লাখ ভোটার ভোট দেবেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশি প্রবাসীরা পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। এই পদক্ষেপটি দেশের সীমানার বাইরে ভোটারদের অংশগ্রহণের পরিধি বাড়ানোর একটি ধাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এ ছাড়াও, আসন্ন নির্বাচনের জন্য ভোটের সময় আট ঘণ্টা থেকে নয় ঘণ্টায় বাড়ানো হয়েছে। এই সংস্কারগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আস্থা পুনরুদ্ধার এবং নির্বাচনের নিরাপত্তা ও অখণ্ডতা নিশ্চিত করার বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ।
নির্বাচনের নিরাপত্তা আরও জোরদার করার জন্য, সাধারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হবে। কারণ শেখ হাসিনার শাসনকালে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়া নির্বাচন কমিশনে আস্থা পুনরুদ্ধারের উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
প্রধান দলগুলোর প্রতিক্রিয়া
১১ ডিসেম্বর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করার সময় ইউনূস নির্বাচন এবং গণভোটকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক বলে অভিহিত করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই নির্বাচন দেশের গভীর রাজনৈতিক বিভাজনগুলোকে সারিয়ে তুলতে সক্ষম। এটি আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার পথ প্রশস্ত করবে। ইউনূস প্রতিশ্রুতি দেন, নির্বাচনটি উৎসবমুখর, অংশগ্রহণমূলক এবং ন্যায়সঙ্গত হবে, যা হাসিনার নেতৃত্বাধীন পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলোর সঙ্গে সম্পূর্ণ বিপরীত। সেগুলো ছিল ষড়যন্ত্রের ছায়ায় আচ্ছন্ন।
প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (জেআই) এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নির্বাচন ঘোষণার প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং তার ছেলে তারেক রহমানের নেতৃত্বে থাকা বিএনপিকে আসন্ন নির্বাচনে একটি শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর আগে বাংলাদেশে বিএনপি এবং শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগই সাধারণত ক্ষমতায় থেকেছে।
জামায়াতে ইসলামী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে নিষিদ্ধ ছিল, তারাও রাজনৈতিক ময়দানে পুনরায় প্রবেশের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এনসিপি একটি নতুন দল। এই দলটি ২০২৪ সালের গণ-আন্দোলনে জড়িত ছাত্র নেতাদের দ্বারা গঠিত। এই দলটি ভোটারদের মধ্যে তার অবস্থান সুসংহত করার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। দলটিকে তাদের রাজপথের শক্তিকে নির্বাচনী সমর্থনে রূপান্তরিত করতে হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, শেখ হাসিনার দল নির্বাচনের ঘোষণাটিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলেছে, ইউনূস ন্যায়সঙ্গত নির্বাচন আয়োজন করতে পারবেন না। হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের কার্যক্রম অন্তর্বর্তী সরকার নিষিদ্ধ করেছে। এর কারণে দলটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।
সম্প্রতি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
এই সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো বিবেচনা করে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখনও গভীরভাবে উত্তপ্ত, এবং দেশ অশান্তির আশঙ্কাময় হুমকির মুখোমুখি।
অস্থিরতার রেসিপি
শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পর তার সমর্থকদের মধ্যে, বিশেষ করে তার দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এরইমধ্যে বলেছেন, ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করা হলে দলের সমর্থকেরা রাস্তায় নামবে এবং নির্বাচন প্রতিহত করবে।
জয় দাবি করেন, তিনি ও শেখ হাসিনা দেশের ভেতরে দলের সব নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তিনি ব্যাপক বিক্ষোভ ও সম্ভাব্য সংঘর্ষের হুঁশিয়ারি দেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, দলের লাখো কর্মী ও কোটি সমর্থক আন্দোলনে নামতে প্রস্তুত।
ওয়াশিংটন ডিসি থেকে রয়টার্সকে জয় বলেন, ‘‘বৃহৎ পরিসরে বিক্ষোভ হবে… সংঘর্ষ অনিবার্য।’’
এই হুমকি উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আসন্ন নির্বাচনের দিকে দেশ যত এগোচ্ছে, ততই একাধিক ফ্রন্টে উত্তেজনা বাড়ছে। শুধু আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যেই নয়, বরং আওয়ামী লীগের সঙ্গে অন্যান্য রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী (জেআই) ও এনসিপির মধ্যেও সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে।
একই সময়ে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণে নিষিদ্ধ হওয়ায় যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এমন অবস্থা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে উত্তেজনা বাড়াতে পারে। এই দুই দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের বিরোধ থাকলেও, অতীতে তারা প্রায়ই হাসিনাবিরোধী অবস্থানে একমত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা ক্ষমতা ও প্রভাবের জন্য একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হয়েছে। হাসিনা পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতায় আধিপত্য বিস্তারের এই প্রতিযোগিতা রাজনৈতিক অস্থিরতাকে আরও তীব্র করতে পারে। পাশাপাশি, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর অভ্যন্তরীণ বিভক্তিও অস্থিরতা বাড়াতে ভূমিকা রাখতে পারে।

দলগুলোর মধ্যে, দলগুলোর ভেতরে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্যকার এই বহুমাত্রিক সংঘাত নির্বাচনের আগে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। এতে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। তাদের দায়িত্ব একটি শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা। রাজনৈতিক বিভাজন গভীর হচ্ছে । ওইদিকে আওয়ামী লীগের সংঘর্ষের হুঁশিয়ারি পরিস্থিতিকে আরও অস্থির করে তুলছে। এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা, প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতা করা এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এসব উত্তেজনা সঠিকভাবে সামাল দেওয়া না গেলে, তা শুধু নির্বাচন ব্যাহতই করবে না, বরং বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
আসন্ন নির্বাচন সরকারের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সক্ষমতার একটি বড় পরীক্ষা হতে যাচ্ছে। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন ও রাষ্ট্রীয় সংস্কার বিষয়ে গণভোট বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপথে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো নতুনভাবে গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে এতে। এই নির্বাচন কেবল নতুন সরকার বাছাইয়ের বিষয় নয়। এর সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণের প্রশ্নও জড়িত।
এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে বাংলাদেশ যেভাবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পথে এগোতে পারে, সেদিকে তাকিয়ে থাকবে গোটা বিশ্ব। বাংলাদেশের জন্য এই মুহূর্তে ঝুঁকি ও সম্ভাবনা দুটোই রয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
লেখক: ঢাকাভিত্তিক একজন ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং কলামিস্ট
(নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন ইয়াসিন আরাফাত)

বাংলাদেশ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং রাষ্ট্রীয় সংস্কারের ওপর গণভোটের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ২০২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনের কথা রয়েছে। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি টার্নিং পয়েন্ট।
এই ভোট অনুষ্ঠিত হবে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে হওয়া ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিশাল গণ-আন্দোলনের দেড় বছর পার হওয়ার পর। ওই আন্দোলনের ফলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। এখন তিনি ভারতে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দেশকে এখন প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় সংস্কারের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারকেও সংস্কার বিলম্বের কারণে নতুন করে বিক্ষোভের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে গভীর বিভক্তি দেখা দিয়েছিল। কয়েক মাস ধরে মুহাম্মদ ইউনূস কোনো নির্দিষ্ট সময়সূচি দিতে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন, যা কিছু রাজনৈতিক দলের মধ্যে ক্ষোভ বাড়িয়ে তুলছিল। অবশেষে ইউনূস ২০২৬ সালের জুন মাসে নির্বাচনের ঘোষণা দেন। কিন্তু ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে তিনি প্রথমে নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তন করে এপ্রিলে আনেন এবং শেষ পর্যন্ত তা আরও কমিয়ে ফেব্রুয়ারিতে নিয়ে আসেন।
এই নির্বাচন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ভোটারা শুধু নতুন আইনপ্রণেতা নির্বাচন করবেন না, একই সঙ্গে ‘জুলাই সনদ’ নামের প্রস্তাবিত সংস্কার প্যাকেজের ওপর গণভোটেও অংশ নেবেন। ২০২৪ সালের গণ-আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি এই রাষ্ট্রীয় সংস্কার পরিকল্পনায়—নির্বাহী ক্ষমতা সংকোচন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা জোরদার এবং নির্বাচন কমিশনসহ গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বায়ত্তশাসন বৃদ্ধির মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব রয়েছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপব্যবহার রোধ করার লক্ষ্যও এতে অন্তর্ভুক্ত।
উদ্দেশ্য হলো ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের দাবিগুলো পূরণ করে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা ও ক্ষমতাকে জবাবদিহিমূলক করে তোলা। কিন্তু গণভোটটি নিজেই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
২০২৬ সালের সাধারণ নির্বাচন অন্তর্বর্তী প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে একটি নতুন ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত হবে। ৩০০টি নির্বাচনী এলাকায় প্রায় ১২ কোটি ৭৬ লাখ ভোটার ভোট দেবেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশি প্রবাসীরা পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। এই পদক্ষেপটি দেশের সীমানার বাইরে ভোটারদের অংশগ্রহণের পরিধি বাড়ানোর একটি ধাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এ ছাড়াও, আসন্ন নির্বাচনের জন্য ভোটের সময় আট ঘণ্টা থেকে নয় ঘণ্টায় বাড়ানো হয়েছে। এই সংস্কারগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আস্থা পুনরুদ্ধার এবং নির্বাচনের নিরাপত্তা ও অখণ্ডতা নিশ্চিত করার বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ।
নির্বাচনের নিরাপত্তা আরও জোরদার করার জন্য, সাধারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হবে। কারণ শেখ হাসিনার শাসনকালে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়া নির্বাচন কমিশনে আস্থা পুনরুদ্ধারের উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
প্রধান দলগুলোর প্রতিক্রিয়া
১১ ডিসেম্বর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করার সময় ইউনূস নির্বাচন এবং গণভোটকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক বলে অভিহিত করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই নির্বাচন দেশের গভীর রাজনৈতিক বিভাজনগুলোকে সারিয়ে তুলতে সক্ষম। এটি আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার পথ প্রশস্ত করবে। ইউনূস প্রতিশ্রুতি দেন, নির্বাচনটি উৎসবমুখর, অংশগ্রহণমূলক এবং ন্যায়সঙ্গত হবে, যা হাসিনার নেতৃত্বাধীন পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলোর সঙ্গে সম্পূর্ণ বিপরীত। সেগুলো ছিল ষড়যন্ত্রের ছায়ায় আচ্ছন্ন।
প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (জেআই) এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নির্বাচন ঘোষণার প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং তার ছেলে তারেক রহমানের নেতৃত্বে থাকা বিএনপিকে আসন্ন নির্বাচনে একটি শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর আগে বাংলাদেশে বিএনপি এবং শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগই সাধারণত ক্ষমতায় থেকেছে।
জামায়াতে ইসলামী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে নিষিদ্ধ ছিল, তারাও রাজনৈতিক ময়দানে পুনরায় প্রবেশের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এনসিপি একটি নতুন দল। এই দলটি ২০২৪ সালের গণ-আন্দোলনে জড়িত ছাত্র নেতাদের দ্বারা গঠিত। এই দলটি ভোটারদের মধ্যে তার অবস্থান সুসংহত করার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। দলটিকে তাদের রাজপথের শক্তিকে নির্বাচনী সমর্থনে রূপান্তরিত করতে হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, শেখ হাসিনার দল নির্বাচনের ঘোষণাটিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলেছে, ইউনূস ন্যায়সঙ্গত নির্বাচন আয়োজন করতে পারবেন না। হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের কার্যক্রম অন্তর্বর্তী সরকার নিষিদ্ধ করেছে। এর কারণে দলটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।
সম্প্রতি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
এই সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো বিবেচনা করে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখনও গভীরভাবে উত্তপ্ত, এবং দেশ অশান্তির আশঙ্কাময় হুমকির মুখোমুখি।
অস্থিরতার রেসিপি
শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পর তার সমর্থকদের মধ্যে, বিশেষ করে তার দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এরইমধ্যে বলেছেন, ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করা হলে দলের সমর্থকেরা রাস্তায় নামবে এবং নির্বাচন প্রতিহত করবে।
জয় দাবি করেন, তিনি ও শেখ হাসিনা দেশের ভেতরে দলের সব নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তিনি ব্যাপক বিক্ষোভ ও সম্ভাব্য সংঘর্ষের হুঁশিয়ারি দেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, দলের লাখো কর্মী ও কোটি সমর্থক আন্দোলনে নামতে প্রস্তুত।
ওয়াশিংটন ডিসি থেকে রয়টার্সকে জয় বলেন, ‘‘বৃহৎ পরিসরে বিক্ষোভ হবে… সংঘর্ষ অনিবার্য।’’
এই হুমকি উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আসন্ন নির্বাচনের দিকে দেশ যত এগোচ্ছে, ততই একাধিক ফ্রন্টে উত্তেজনা বাড়ছে। শুধু আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যেই নয়, বরং আওয়ামী লীগের সঙ্গে অন্যান্য রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী (জেআই) ও এনসিপির মধ্যেও সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে।
একই সময়ে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণে নিষিদ্ধ হওয়ায় যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এমন অবস্থা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে উত্তেজনা বাড়াতে পারে। এই দুই দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের বিরোধ থাকলেও, অতীতে তারা প্রায়ই হাসিনাবিরোধী অবস্থানে একমত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা ক্ষমতা ও প্রভাবের জন্য একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হয়েছে। হাসিনা পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতায় আধিপত্য বিস্তারের এই প্রতিযোগিতা রাজনৈতিক অস্থিরতাকে আরও তীব্র করতে পারে। পাশাপাশি, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর অভ্যন্তরীণ বিভক্তিও অস্থিরতা বাড়াতে ভূমিকা রাখতে পারে।

দলগুলোর মধ্যে, দলগুলোর ভেতরে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্যকার এই বহুমাত্রিক সংঘাত নির্বাচনের আগে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। এতে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। তাদের দায়িত্ব একটি শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা। রাজনৈতিক বিভাজন গভীর হচ্ছে । ওইদিকে আওয়ামী লীগের সংঘর্ষের হুঁশিয়ারি পরিস্থিতিকে আরও অস্থির করে তুলছে। এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা, প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতা করা এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এসব উত্তেজনা সঠিকভাবে সামাল দেওয়া না গেলে, তা শুধু নির্বাচন ব্যাহতই করবে না, বরং বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
আসন্ন নির্বাচন সরকারের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সক্ষমতার একটি বড় পরীক্ষা হতে যাচ্ছে। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন ও রাষ্ট্রীয় সংস্কার বিষয়ে গণভোট বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপথে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো নতুনভাবে গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে এতে। এই নির্বাচন কেবল নতুন সরকার বাছাইয়ের বিষয় নয়। এর সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণের প্রশ্নও জড়িত।
এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে বাংলাদেশ যেভাবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পথে এগোতে পারে, সেদিকে তাকিয়ে থাকবে গোটা বিশ্ব। বাংলাদেশের জন্য এই মুহূর্তে ঝুঁকি ও সম্ভাবনা দুটোই রয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
লেখক: ঢাকাভিত্তিক একজন ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং কলামিস্ট
(নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন ইয়াসিন আরাফাত)