আগুনের বয়স আসলে কত?

আগুনের বয়স আসলে কত?
প্রতীকী ছবি। এআই দিয়ে তৈরি

আমরা এতদিন জানতাম আগুনের আবিষ্কার হয় উত্তর ফ্রান্সে আজ থেকে ৫০ হাজার বছর আগে। কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের এক গবেষক দল বলছে ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্যমতে, আগুন বশে এসেছে প্রায় ৪ লাখ বছর আগে!

এই আবিষ্কারকে গবেষকরা অভিহিত করছেন ‘যুগান্তকারী’ হিসেবে। তারা বলছেন, ৪ লাখ বছর আগে আগুন বশে এনেছিল আধুনিক মানুষের নিকটাত্মীয় প্রজাতি নিয়ান্ডারথাল’রা। তারাই আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছিল বলে দাবি করা হচ্ছে।  

প্রায় দুই দশক ধরে নিজের সহকর্মীদের নিয়ে ব্রিটেনের সাফোকের বার্নহামের একটি প্রত্নতাত্ত্বিক খননস্থলে কাজ করছেন সায়মন পারফিট। তাদের খননে সিংহের, বিভারের (ইঁদুরের মতো দেখতে এক ধরনের প্রানী), এমনকি বানরের জীবাশ্মও মিলেছে। তবে এবার যে আবিষ্কারটি মানব বিবর্তনের ইতিহাস বদলে দিতে চলেছে, তা হলো—মাত্র দুই সেন্টিমিটারের পাথরের দুটি ক্ষুদ্র অংশ!

৪০০,০০০ বছর পুরোনো ক্যাম্পফায়ারের চুল্লির সাথে এই খণ্ডগুলো পাওয়া গেছে। এগুলো পাইরাইট নামে পরিচিত। গবেষকেরা বলছেন, এই টুকরোগুলো প্রমাণ করে যে এই আগুন কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না, বরং এটি ইচ্ছে করেই জ্বালানো ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছিল। সময়ের হিসাবে সেও প্রায় বরফ যুগের কথা। এর অর্থ হলো, তখন থেকেই বর্তমানের মানুষের পূর্বপুরুষেরা ঠান্ডা থেকে বাঁচতে আগুন ব্যবহার করত।

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের মানব বিবর্তন গবেষণা টিমের একজন জ্যেষ্ঠ গবেষক সায়মন পারফিট। পাইরাইটের খণ্ডগুলো যখন পাওয়া যায়, সেই মুহূর্তে তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সায়মন বলেন, “আমরা যখনই পাইরাইটটি দেখলাম, তখনই বুঝতে পারলাম যে আমরা অসাধারণ কিছু খুঁজে পেয়েছি। কারণ এই ভূ-প্রকৃতিতে পাইরাইট প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যায় না। এর উপস্থিতিই প্রমাণ করে যে ইচ্ছামতো আগুন তৈরি করার ক্ষমতা তখনকার মানুষের ছিল। এই পাইরাইটটি ছিল মূলত কোনো আগুন জ্বালার যন্ত্রের একটা অংশ।”

ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন তৈরির প্রমাণ প্রত্নতাত্ত্বিক রেকর্ডে খুব কমই সংরক্ষিত থাকে। কারণ ছাই সহজে ছড়িয়ে যায়, কাঠকয়লা পচে যায় এবং তাপমাত্রার পরিবর্তনের কারণে পলি ক্ষয়প্রাপ্ত হতে পারে।

তবে এই দগ্ধ পলি প্রাচীন পুকুরের পলির মধ্যে সিল করা অবস্থায় ছিল। বিজ্ঞানীরা এই পলি পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে আদিম মানুষ কীভাবে স্থানটি ব্যবহার করত, তা বোঝার চেষ্টা করেছেন। গবেষকরা বলছেন, মানব সভ্যতার বিবর্তনে এই ঘটনার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, আগুন আদিম জনগোষ্ঠীকে শীতল পরিবেশে টিকে থাকতে, হিংস্র প্রানীদের ভয় দেখাতে এবং খাবার রান্না করতে সাহায্য করত। রান্না করা হলে উদ্ভিদের মূল ও কন্দের বিষাক্ত অংশ এবং মাংসে থাকা রোগজীবাণু ধ্বংস হয়, যা হজমের উন্নতি ঘটায়। আবার এই প্রক্রিয়া আকারে বড় মস্তিষ্কের বিকাশেও সহায়তা করে।

ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের মানব বিবর্তন বিশেষজ্ঞ ক্রিস স্ট্রিংগার বলছেন, ব্রিটেন ও স্পেনের জীবাশ্মগুলো থেকে বোঝা যায় যে বার্নহামের বাসিন্দারা ছিল আদি নিয়ান্ডারথাল।

নিয়ান্ডারথাল আধুনিক মানুষের একটি বিলুপ্ত ও নিকটাত্মীয় প্রজাতি যারা প্রায় ৪ লাখ থেকে ৪০ হাজার বছর আগে ইউরোপ ও এশিয়ায় বসবাস করত। তারা তাদের পেশীবহুল গঠন, বড় মাথা, বিশাল নাক ও বুদ্ধিমত্তার কারণে মানব বিবর্তনে উল্লেখযোগ্য হয়ে আছে।

বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, ওই সময়ে আগুনের ব্যবহার তাদের সামাজিক জীবনেও প্রভাব রেখেছিল। তারা হয়তো চুলার চারপাশে সন্ধ্যায় জমায়েত হওয়ার পরিকল্পনা, গল্প বলা ও দলগত সম্পর্ক জোরদার করার জন্য সময় দিত। এ ধরনের কাজ আবার ভাষা ও আরও সংগঠিত সমাজের বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা রাখে।

প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলছেন, বার্নহামের ওই এলাকাটি প্রায় ৫ থেকে ৪ লাখ বছর আগেকার এশিয়া ও ইউরোপের সাথে মানানসই। সেই সময়েই আদিম মানুষের মস্তিষ্কের আকার আধুনিক মানুষের মস্তিষ্কের কাছাকাছি আসতে শুরু করে।

ব্রিটিশ মিউজিয়ামের প্যালিওলিথিক সংগ্রহের কিউরেটর নিক অ্যাশটন এটিকে তার দীর্ঘ ৪০ বছরের কর্মজীবনের ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার’ হিসেবে দাবি করেছেন।

৪ লাখ বছর আগে মানুষের আদি প্রজাতি আগুনের ব্যবহার শুরু করেছিল—এমন তথ্য প্রত্নতাত্ত্বিকদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তখন থেকেই মানব সভ্যতা সামনে এগিয়ে গেছে। আলোর জন্য বজ্রপাত ও দাবানলের ওপর নির্ভর করা বন্ধ করে আলোর উৎসের ওপর নিয়ন্ত্রণ এলো ক্রমে।

সাধারণত আগুনের আবিষ্কারকে মানুষের প্রকৃতির মর্জির ওপর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে ওঠার লক্ষণ হিসেবে দেখা হয়। এরপর ধীরে ধীরে প্রকৃতিকে বশে আনার নেশায় মজে মানুষ। এখন সেই আগুনের আবিষ্কার নিয়েই নতুন তথ্য চলে এসেছে। চলমান গবেষণায় হয়তো আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও মিলবে ক্রমে। তাতে শেষে মানব সভ্যতার ইতিহাসই পুরো বদলে যায় কিনা, কে জানে!

তথ্যসূত্র: ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম, বিবিসি, দ্য হিউম্যান জার্নি ও এনডিটিভি

সম্পর্কিত