আরপিও সংশোধনে যুক্ত হলো যেসব বিধান

অনিয়ম ধরা পড়লে সম্পূর্ণ আসনের ভোট বাতিল করার ক্ষমতা থাকবে নির্বাচন কমিশনের হাতে।

চরচা প্রতিবেদক
চরচা প্রতিবেদক
আরপিও সংশোধনে যুক্ত হলো যেসব বিধান
ছবি: চরচা

আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সোমবার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করে যে অধ্যাদেশ জারি হয়েছে তাতে যুক্ত হয়েছে একাধিক নতুন বিধান। পরিবর্তন এসেছে কিছু পুরনো নিয়মেও। এই সংশোধিত আরপিও অনুযায়ীই শিগগিরই দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা চূড়ান্ত করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

নতুন নিয়ম অনুযায়ী, এখন থেকে আদালত ঘোষিত পলাতক বা ফেরারি আসামিরা ভোটে প্রার্থী হতে পারবেন না। প্রায় ১৫ বছর পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। একক প্রার্থী থাকা আসনে ফিরছে ‘না’ ভোটের ব্যবস্থা।

সমান ভোট পড়লে পুনঃভোট অনুষ্ঠিত হবে। জোট গঠন করে নির্বাচন করলেও প্রার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে নিজেদের দলের প্রতীকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। প্রার্থিতা বজায় রাখতে জামানত নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। কোনো রাজনৈতিক দল আচরণবিধি ভাঙলে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান থাকছে।

তথ্যপ্রযুক্তি সহায়তায় এবার চালু হচ্ছে পোস্টাল ভোটিং ব্যবস্থা। অনিয়ম ধরা পড়লে সম্পূর্ণ আসনের ভোট বাতিল করার ক্ষমতা থাকবে নির্বাচন কমিশনের হাতে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) অপব্যবহার করলে তা গণ্য হবে নির্বাচনী অপরাধ হিসেবে। পাশাপাশি, প্রার্থী যদি হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দেন, তাহলে নির্বাচিত হওয়ার পরও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে নির্বাচন কমিশন।

নতুন সংযোজন ও পরিবর্তন

অনুচ্ছেদ-২

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় এবার সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে এমন বিধান ছিল, কিন্তু পরবর্তী তিন নির্বাচনে তা বাদ ছিল। এবার সংশোধনের মাধ্যমে সেই ধারা আবার ফিরে এসেছে।

অনুচ্ছেদ-৮

ভোটকেন্দ্র (পোলিং স্টেশন) তৈরির দায়িত্ব এখন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার ওপর থাকবে। তারা সংশ্লিষ্ট তালিকা প্রস্তুত করে নির্বাচন কমিশনের অনুমোদনের জন্য পাঠাবেন।

অনুচ্ছেদ-৯

রিটার্নিং অফিসার কোনো ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিলে সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত করতে হবে।

অনুচ্ছেদ-১২

যে ব্যক্তি আদালতের রায়ে ফেরারি বা পলাতক আসামি হিসেবে ঘোষিত হবেন, তিনি সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য বিবেচিত হবেন এবং প্রার্থীও হতে পারবেন না। সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বা অন্য কোনো পদে থাকলেও প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা হারাবেন।

কোনো প্রতিষ্ঠানের কার্যনির্বাহী পদকে ‘লাভজনক’ পদ হিসেবে সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, ফলে এমন পদে থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া যাবে না। প্রার্থীর হলফনামায় দেশে ও বিদেশে আয়ের উৎসসহ সর্বশেষ অর্থবছরের রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

হলফনামায় যদি অসত্য তথ্য প্রদান প্রমাণিত হয়, তাহলে নির্বাচনের পরও নির্বাচন কমিশন প্রার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে।

অনুচ্ছেদ-১৩

মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হবে ৫০ হাজার টাকার জামানত, যা আগে ছিল ২০ হাজার।

অনুচ্ছেদ-১৪

রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হলে প্রার্থী ছাড়াও ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারি সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলো আপিল করার সুযোগ পাবে।

অনুচ্ছেদ-১৯

‘না’ ভোটের বিধান পুনঃপ্রবর্তন করা হয়েছে। কোনো আসনে একমাত্র প্রার্থী থাকলে ব্যালট পেপারে ‘না’ ভোটের ঘর থাকবে। তবে পুনঃনির্বাচনের ক্ষেত্রে এই বিধান কার্যকর থাকবে না।

অনুচ্ছেদ-২০

নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো জোট গঠন করলেও প্রার্থীদের নিজ নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে; এমন বাধ্যতামূলক বিধান যোগ হয়েছে।

অনুচ্ছেদ-২১

নির্বাচনী এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটার হওয়া আবশ্যক।

অনুচ্ছেদ-২৫

প্রিজাইডিং কর্মকর্তার দায়িত্ব ও ক্ষমতা আরও বাড়ানো হয়েছে।

অনুচ্ছেদ-২৬

ইভিএমে ভোটগ্রহণের বিধান সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা হয়েছে। ইভিএম-সংক্রান্ত সব ধারাই বিলোপ করা হয়েছে।

অনুচ্ছেদ-২৭

নতুনভাবে সংযোজিত হয়েছে পোস্টাল ভোটিং ব্যবস্থা। এবার প্রবাসী, সরকারি চাকরিজীবী ও দেশের ভেতরে আটক ভোটাররাও ডাকযোগে ভোট দিতে পারবেন। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় পরিচালিত পোস্টাল ভোটিংয়ের ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকছে না।

অনুচ্ছেদ-২৯

ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের অনুমতিপ্রাপ্তদের তালিকায় গণমাধ্যমকর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

অনুচ্ছেদ-৩৬

ভোট গণনার সময় গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের উপস্থিত থাকার বিধান সংযোজিত হয়েছে।

অনুচ্ছেদ-৩৭

আগে বাতিল ভোট গণনা বাধ্যতামূলক ছিল, এখন তা প্রিজাইডিং অফিসারের বিবেচনার ওপর নির্ভর করবে। তিনি প্রয়োজন মনে করলে সেই ভোটগুলো পুনরায় গণনা করতে পারবেন।

অনুচ্ছেদ-৩৮

সমান ভোট পড়লে এখন থেকে লটারির পরিবর্তে পুনঃভোট অনুষ্ঠিত হবে। পূর্বে সমভোট প্রাপ্ত প্রার্থীদের মধ্যে লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত করা হতো।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

অনুচ্ছেদ-৪৪

এই অনুচ্ছেদে একাধিক নতুন সংযোজন এসেছে। প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয়ের সীমা ভোটারপ্রতি ১০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। দলীয় পর্যায়ে ব্যয়ের হিসাব যুক্ত করে আরও পরিমার্জন আনা হয়েছে।

অনুদান হিসেবে প্রাপ্ত অর্থের বিস্তারিত তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নির্বাচনী কর্মকর্তাদের বদলির ক্ষেত্রে উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক পদও এখন অন্তর্ভুক্ত।

অনুচ্ছেদ-৭৩

ভুয়া তথ্য, গুজব, অপতথ্য ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) অপব্যবহার রোধে প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ব্যবস্থার বিধান সংযোজন করা হয়েছে।

অনুচ্ছেদ-৭৪, ৮১, ৮৭ ও ৮৯:

ভাষাগত এবং ছোটখাট পরিমার্জন আনা হয়েছে।

অনুচ্ছেদ-৯০

দল নিবন্ধন ও অনুদান ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট ধারায় বলা হয়েছে, নিবন্ধন স্থগিত হলে দলের প্রতীকও স্থগিত থাকবে।

অনুচ্ছেদ-৯১

অনিয়ম প্রমাণিত হলে কেন্দ্রের ভোটের পাশাপাশি পুরো নির্বাচনী এলাকার ফলও বাতিল করতে পারবে নির্বাচন কমিশন।

আচরণবিধি ভঙ্গের শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা দেড় লাখ টাকা জরিমানার বিধান যুক্ত হয়েছে। দলীয় পর্যায়েও জরিমানার সুযোগ রাখা হয়েছে।

নির্বাহী ও বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়াও কমিশনের অনুমোদিত কর্মকর্তারা এখন এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারবেন।

একই অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে-প্রার্থী হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলে নির্বাচন শেষে যাচাই-বাছাই করে ইসি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে।

সম্পর্কিত