জেমস পামার

চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ)-তে যারা যোগদান করে, তাদের বেশির ভাগকে বাধ্যতামূলক সৈনিক বলা হলেও, বাস্তবে এটি সবসময় স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী ছিল। সেনাবাহিনীতে কাউকে জোর করে নিয়োগ দেওয়া হয় না এবং সেনাবাহিনীর যে লক্ষ্য থাকে তা পূরণের জন্য খুব একটা সমস্যায় পড়তে হয় না তাদেরকে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অল্প সময়ের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হয়, তবে তা হালকা ধরনের কাজ যেমন কুচকাওয়াজ, স্লোগান দেওয়া বা প্রচার সংক্রান্ত।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চীনা সৈনিকদের সামাজিক মর্যাদা বিবর্তিত হয়েছে। সামরিক বাহিনীর কাজকে ঐতিহাসিকভাবে নিষ্ঠুর ও বিপজ্জনক মনে করা হতো। কোনো ভদ্র বা সভ্য মানুষ সাধারণত সেনাবাহিনীতে যোগ দিত না–এমন ধারনাই প্রচলিত ছিল। কনফুসিয়ান ইতিহাসবিদেরা এই পেশাকে তাচ্ছিল্য করতেন। তৎকালীন চীনে একটি প্রচলিত প্রবাদ ছিল- “ভালো লোহা দিয়ে যেমন পেরেক বানানো হয় না, তেমনি ভালো মানুষ কখনো সৈনিক হয় না।”
১৯১০ থেকে ১৯৪০–এই তিন দশকে যখন গৃহযুদ্ধ ও বিদেশি আগ্রাসনে চীন বিপর্যস্ত ছিল, তখন কোনো ইউনিফর্ম পরা সৈনিক দেখলে মানুষ মনে করত ডাকাত। তাই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) সশস্ত্র বাহিনী- যা পরে পিএলএতে পরিণত হয়- নিজেদের ভাবমূর্তি উন্নত করার জন্য বিভিন্ন নেয়।
সোভিয়েত মডেল অনুসরণ করে কমিউনিস্টরা সৈনিকদের সুসংগঠিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ বীর হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, কোরিয়া যুদ্ধে আমেরিকার বিপক্ষে অবস্থান, এর সঙ্গে ব্যাপক প্রচার–চীনা সৈনিকদের মর্যাদা অনেক বাড়িয়ে দেয়। দীর্ঘদিন এই ভাবমূর্তি বজায় ছিল। ১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর, বিশেষ করে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়, গ্রামীণ তরুণদের জীবনমান উন্নত করার অল্প কিছু উপায়ের একটি ছিল সেনাবাহিনীতে যোগদান।
তবে ১৯৭৯ সালের পর পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। চীনের অর্থনীতি আধুনিকায়ন হতে থাকে এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও শহুরে উন্নত জীবন সেনাবাহিনীর তুলনায় বেশি আয়ের সুযোগ করে দেয়। উপরন্তু অন্যান্য পেশায় সামাজিক মর্যাদাও সৈনিকদের তুলনায় বেশি। সাধারণ মানুষ যখন আর রেশনের বিনিময়ে কঠোর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে বাস করতে বাধ্য ছিল না, তখন সেনাবাহিনীর চাকরিকে অনেকের কাছে পশ্চাৎপদ মনে হতে থাকে।
১৯৮৯ সালের জুনে তিয়ানানমেন স্কয়ারে হত্যাকাণ্ডের পর সাধারণ মানুষ পিএলএ-কে ভয়ের দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। এরপর সৈনিকদের যাতে নিজ নিজ প্রদেশে নিয়োগ না দেওয়া হয়- সেই নিয়ম চালু হয়। কারণ আশঙ্কা ছিল ভবিষ্যতে কোনো বিক্ষোভ সৃষ্টি হলে তারা বিক্ষোভকারীদের পক্ষে দাঁড়াতে পারে। প্রায় একই সময়ে চীনে এক-সন্তান নীতি প্রণয়ন করা হয়, ফলে নিয়োগপ্রক্রিয়া আরও জটিল হয়ে যায়। কারণ দীর্ঘ সময় সৈনিকদের একা হাতে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের দেখভাল করতে হতো।
পিএলএতে বর্তমানে গ্রামাঞ্চল থেকে বেশি নিয়োগ দেওয়া হয়, তবে শিক্ষার গুরুত্ব বেড়েছে। দুই দশক আগেও তালিকাভুক্ত সৈনিকদের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি নবম শ্রেণি বা তার কম শিক্ষিত ছিল; এখন সেই হার ৪ শতাংশেরও কম, এবং অনেকের কলেজ পাঠের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে সেনাবাহিনীতে নারীদের অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম। ২০০০ সালে নারীদের উপস্থিতি ছিল ৫.৪ শতাংশ, সেখানে ২০২০ সালে তা ৩.৮ শতাংশে নেমে এসেছে।

বেকারত্ব বৃদ্ধি, ভালো বেতন ও সুযোগ-সুবিধা, রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে সৈনিকদের মহিমান্বিত করা সত্ত্বেও পিএলএ এখন তরুণদেরকে আকর্ষণ করতে পারছে না। সাধারণ জীবন থেকে সামরিক জীবন বিচ্ছিন্ন, নিয়ন্ত্রণমূলক ও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। ২০১৫ সাল পর্যন্ত চীনা সৈনিকদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের অনুমতি ছিল না, এবং এখনও পশ্চিমা সেনাদের তুলনায় তারা বেশি নজরদারি ও বিধিনিষেধের মধ্যে থাকে।
এতদিন সৈনিকদের আবাসন ব্যবস্থাও ছিল উন্নত ছিল না, যদিও প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের আমলে জীবনমান উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। (তবে পিএলএ সৈনিকরা কিছু ব্যতিক্রম বাদে তাদের রান্নার মান নিয়ে সন্তুষ্ট।) তবুও, প্রত্যন্ত সীমান্ত অঞ্চলের ঘাঁটিগুলোতে জীবন একঘেয়ে ও কঠিন, যেখানে সুযোগ-সুবিধা ও বিনোদনের অভাব রয়েছে।
পিএলএতে বৈবাহিক সম্পর্ক বজায় রাখাও কঠিন। অনেক সৈনিক বছরে মাত্র ৪০ দিন তাদের সঙ্গীর সঙ্গে সময় কাটাতে পারেন, এবং পরিবারসহ একসঙ্গে থাকার অধিকার পেতে দশ বছর বা তারও বেশি সময় লেগে যেতে পারে। এদিকে, সৈনিকদের স্ত্রীদের জন্য বিবাহবিচ্ছেদেও বিধিনিষেধ রয়েছে। কার্যত, এসব নিয়ম সৈনিকদের আশ্বস্ত করার জন্য তৈরি এবং বাস্তবে বিবাহ করাকে নিরুৎসাহিত করে।
অন্যান্য সেনাবাহিনীর মতোই চীনা সৈনিকদের দৈনন্দিন জীবন রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রশিক্ষণকে ঘিরে আবর্তিত হয়, তবে তাদের রাজনৈতিক শিক্ষার ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়। কমিশনাররা সৈন্যদের শিক্ষা ও মনোবল তদারকি করেন এবং কর্মকর্তাদের আনুগত্য পর্যবেক্ষণ করেন। বাস্তবে এটা খেলাধুলা, দলগত কর্মকাণ্ড এবং কৃত্রিম রাজনৈতিক বক্তৃতার মিশ্রণ।
সাবেক সৈনিক ও রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় পিএলএতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নেই বললেই চলে। অন্যান্য সেনাবাহিনীর তুলনায় কর্তৃত্ববাদ অনেক বেশি। এমনকি দুর্নীতির সংস্কৃতিও চলমান। সরকার বড় আকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও ছোটখাটো দুর্নীতির ক্ষেত্রে নির্বিকার থাকে, যেমন: ক্যান্টিনের অর্থ আত্মসাৎ।
পিএলএতে পদোন্নতির সুযোগ সীমিত। নন-কমিশন্ড অফিসার থেকে অফিসার হতে হলে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়, যদিও ঐতিহাসিকভাবে এতে অংশগ্রহণ কম। চাকরি শেষ হলে খুব একটা সহায়তাও পাওয়া যায় না। আমেরিকায় যেমন প্রবীণ সৈনিকদের জন্য শিক্ষা বা স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি আছে, চীনে তা নেই। অনেক সৈনিক অবসরের পর প্রহরী হিসেবে কাজ করেন, অনেকে আবার ভাড়াটে গুন্ডা হয়ে অপরাধজগতে জড়িয়ে পড়েন।
স্থানীয় সরকারগুলোর প্রবীণ সৈনিকদের পেনশন ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে এর কোনো প্রয়োগ নেই। এই ব্যবস্থা প্রতিকারের জন্য অনেকে প্রতিবাদ করছেন। ১৯৭৯ সালের চীন–ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রবীণ সৈনিকরা বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ, কারণ তারা কোনো পেনশন পাননি এবং তাদের ধারণা সরকার যেন এই যুদ্ধকে ভুলে যেতে চায়।
শি জিনপিং প্রশাসন এসব সমস্যা মোকাবিলায় কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন: ২০১৮ সালে প্রবীণদের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা এবং এ বিষয়ে ২০২০ সালে নতুন আইন পাস করা হয়েছে। তবে কোভিড-১৯ মহামারি ও স্থানীয় সরকারের ঋণ সংকটের কারণে এসব সুবিধা কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির কাছে পৌঁছায় না।
যদিও সংস্কারের ফলে সাধারণ সৈনিকদের জীবন কিছুটা উন্নত হয়েছে, তবুও পিএলএর মর্যাদা আজ গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের শুরুর বছরগুলোর তুলনায় অনেক কম। সামরিক কুচকাওয়াজের জাঁকজমক বা দেশপ্রেম জাগানিয়া বক্তব্যের পাশাপাশি এটাও মনে রাখা দরকার যে সাধারণ চীনা সৈনিকও একজন মানুষ, তার পায়ে ফোস্কা পড়া অথবা নিজের শহর ও বাড়ির জন্য হাহাকার করা এক তরুণ।
জেমস পামার: উপ-সম্পাদক, ফরেন পলিসি
ফরেন পলিসি অবলম্বনে। অনুবাদ: ইয়াসির আরাফাত।

চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ)-তে যারা যোগদান করে, তাদের বেশির ভাগকে বাধ্যতামূলক সৈনিক বলা হলেও, বাস্তবে এটি সবসময় স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী ছিল। সেনাবাহিনীতে কাউকে জোর করে নিয়োগ দেওয়া হয় না এবং সেনাবাহিনীর যে লক্ষ্য থাকে তা পূরণের জন্য খুব একটা সমস্যায় পড়তে হয় না তাদেরকে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অল্প সময়ের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হয়, তবে তা হালকা ধরনের কাজ যেমন কুচকাওয়াজ, স্লোগান দেওয়া বা প্রচার সংক্রান্ত।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চীনা সৈনিকদের সামাজিক মর্যাদা বিবর্তিত হয়েছে। সামরিক বাহিনীর কাজকে ঐতিহাসিকভাবে নিষ্ঠুর ও বিপজ্জনক মনে করা হতো। কোনো ভদ্র বা সভ্য মানুষ সাধারণত সেনাবাহিনীতে যোগ দিত না–এমন ধারনাই প্রচলিত ছিল। কনফুসিয়ান ইতিহাসবিদেরা এই পেশাকে তাচ্ছিল্য করতেন। তৎকালীন চীনে একটি প্রচলিত প্রবাদ ছিল- “ভালো লোহা দিয়ে যেমন পেরেক বানানো হয় না, তেমনি ভালো মানুষ কখনো সৈনিক হয় না।”
১৯১০ থেকে ১৯৪০–এই তিন দশকে যখন গৃহযুদ্ধ ও বিদেশি আগ্রাসনে চীন বিপর্যস্ত ছিল, তখন কোনো ইউনিফর্ম পরা সৈনিক দেখলে মানুষ মনে করত ডাকাত। তাই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) সশস্ত্র বাহিনী- যা পরে পিএলএতে পরিণত হয়- নিজেদের ভাবমূর্তি উন্নত করার জন্য বিভিন্ন নেয়।
সোভিয়েত মডেল অনুসরণ করে কমিউনিস্টরা সৈনিকদের সুসংগঠিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ বীর হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, কোরিয়া যুদ্ধে আমেরিকার বিপক্ষে অবস্থান, এর সঙ্গে ব্যাপক প্রচার–চীনা সৈনিকদের মর্যাদা অনেক বাড়িয়ে দেয়। দীর্ঘদিন এই ভাবমূর্তি বজায় ছিল। ১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর, বিশেষ করে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়, গ্রামীণ তরুণদের জীবনমান উন্নত করার অল্প কিছু উপায়ের একটি ছিল সেনাবাহিনীতে যোগদান।
তবে ১৯৭৯ সালের পর পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। চীনের অর্থনীতি আধুনিকায়ন হতে থাকে এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও শহুরে উন্নত জীবন সেনাবাহিনীর তুলনায় বেশি আয়ের সুযোগ করে দেয়। উপরন্তু অন্যান্য পেশায় সামাজিক মর্যাদাও সৈনিকদের তুলনায় বেশি। সাধারণ মানুষ যখন আর রেশনের বিনিময়ে কঠোর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে বাস করতে বাধ্য ছিল না, তখন সেনাবাহিনীর চাকরিকে অনেকের কাছে পশ্চাৎপদ মনে হতে থাকে।
১৯৮৯ সালের জুনে তিয়ানানমেন স্কয়ারে হত্যাকাণ্ডের পর সাধারণ মানুষ পিএলএ-কে ভয়ের দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। এরপর সৈনিকদের যাতে নিজ নিজ প্রদেশে নিয়োগ না দেওয়া হয়- সেই নিয়ম চালু হয়। কারণ আশঙ্কা ছিল ভবিষ্যতে কোনো বিক্ষোভ সৃষ্টি হলে তারা বিক্ষোভকারীদের পক্ষে দাঁড়াতে পারে। প্রায় একই সময়ে চীনে এক-সন্তান নীতি প্রণয়ন করা হয়, ফলে নিয়োগপ্রক্রিয়া আরও জটিল হয়ে যায়। কারণ দীর্ঘ সময় সৈনিকদের একা হাতে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের দেখভাল করতে হতো।
পিএলএতে বর্তমানে গ্রামাঞ্চল থেকে বেশি নিয়োগ দেওয়া হয়, তবে শিক্ষার গুরুত্ব বেড়েছে। দুই দশক আগেও তালিকাভুক্ত সৈনিকদের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি নবম শ্রেণি বা তার কম শিক্ষিত ছিল; এখন সেই হার ৪ শতাংশেরও কম, এবং অনেকের কলেজ পাঠের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে সেনাবাহিনীতে নারীদের অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম। ২০০০ সালে নারীদের উপস্থিতি ছিল ৫.৪ শতাংশ, সেখানে ২০২০ সালে তা ৩.৮ শতাংশে নেমে এসেছে।

বেকারত্ব বৃদ্ধি, ভালো বেতন ও সুযোগ-সুবিধা, রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে সৈনিকদের মহিমান্বিত করা সত্ত্বেও পিএলএ এখন তরুণদেরকে আকর্ষণ করতে পারছে না। সাধারণ জীবন থেকে সামরিক জীবন বিচ্ছিন্ন, নিয়ন্ত্রণমূলক ও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। ২০১৫ সাল পর্যন্ত চীনা সৈনিকদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের অনুমতি ছিল না, এবং এখনও পশ্চিমা সেনাদের তুলনায় তারা বেশি নজরদারি ও বিধিনিষেধের মধ্যে থাকে।
এতদিন সৈনিকদের আবাসন ব্যবস্থাও ছিল উন্নত ছিল না, যদিও প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের আমলে জীবনমান উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। (তবে পিএলএ সৈনিকরা কিছু ব্যতিক্রম বাদে তাদের রান্নার মান নিয়ে সন্তুষ্ট।) তবুও, প্রত্যন্ত সীমান্ত অঞ্চলের ঘাঁটিগুলোতে জীবন একঘেয়ে ও কঠিন, যেখানে সুযোগ-সুবিধা ও বিনোদনের অভাব রয়েছে।
পিএলএতে বৈবাহিক সম্পর্ক বজায় রাখাও কঠিন। অনেক সৈনিক বছরে মাত্র ৪০ দিন তাদের সঙ্গীর সঙ্গে সময় কাটাতে পারেন, এবং পরিবারসহ একসঙ্গে থাকার অধিকার পেতে দশ বছর বা তারও বেশি সময় লেগে যেতে পারে। এদিকে, সৈনিকদের স্ত্রীদের জন্য বিবাহবিচ্ছেদেও বিধিনিষেধ রয়েছে। কার্যত, এসব নিয়ম সৈনিকদের আশ্বস্ত করার জন্য তৈরি এবং বাস্তবে বিবাহ করাকে নিরুৎসাহিত করে।
অন্যান্য সেনাবাহিনীর মতোই চীনা সৈনিকদের দৈনন্দিন জীবন রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রশিক্ষণকে ঘিরে আবর্তিত হয়, তবে তাদের রাজনৈতিক শিক্ষার ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়। কমিশনাররা সৈন্যদের শিক্ষা ও মনোবল তদারকি করেন এবং কর্মকর্তাদের আনুগত্য পর্যবেক্ষণ করেন। বাস্তবে এটা খেলাধুলা, দলগত কর্মকাণ্ড এবং কৃত্রিম রাজনৈতিক বক্তৃতার মিশ্রণ।
সাবেক সৈনিক ও রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় পিএলএতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নেই বললেই চলে। অন্যান্য সেনাবাহিনীর তুলনায় কর্তৃত্ববাদ অনেক বেশি। এমনকি দুর্নীতির সংস্কৃতিও চলমান। সরকার বড় আকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও ছোটখাটো দুর্নীতির ক্ষেত্রে নির্বিকার থাকে, যেমন: ক্যান্টিনের অর্থ আত্মসাৎ।
পিএলএতে পদোন্নতির সুযোগ সীমিত। নন-কমিশন্ড অফিসার থেকে অফিসার হতে হলে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়, যদিও ঐতিহাসিকভাবে এতে অংশগ্রহণ কম। চাকরি শেষ হলে খুব একটা সহায়তাও পাওয়া যায় না। আমেরিকায় যেমন প্রবীণ সৈনিকদের জন্য শিক্ষা বা স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি আছে, চীনে তা নেই। অনেক সৈনিক অবসরের পর প্রহরী হিসেবে কাজ করেন, অনেকে আবার ভাড়াটে গুন্ডা হয়ে অপরাধজগতে জড়িয়ে পড়েন।
স্থানীয় সরকারগুলোর প্রবীণ সৈনিকদের পেনশন ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে এর কোনো প্রয়োগ নেই। এই ব্যবস্থা প্রতিকারের জন্য অনেকে প্রতিবাদ করছেন। ১৯৭৯ সালের চীন–ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রবীণ সৈনিকরা বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ, কারণ তারা কোনো পেনশন পাননি এবং তাদের ধারণা সরকার যেন এই যুদ্ধকে ভুলে যেতে চায়।
শি জিনপিং প্রশাসন এসব সমস্যা মোকাবিলায় কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন: ২০১৮ সালে প্রবীণদের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা এবং এ বিষয়ে ২০২০ সালে নতুন আইন পাস করা হয়েছে। তবে কোভিড-১৯ মহামারি ও স্থানীয় সরকারের ঋণ সংকটের কারণে এসব সুবিধা কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির কাছে পৌঁছায় না।
যদিও সংস্কারের ফলে সাধারণ সৈনিকদের জীবন কিছুটা উন্নত হয়েছে, তবুও পিএলএর মর্যাদা আজ গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের শুরুর বছরগুলোর তুলনায় অনেক কম। সামরিক কুচকাওয়াজের জাঁকজমক বা দেশপ্রেম জাগানিয়া বক্তব্যের পাশাপাশি এটাও মনে রাখা দরকার যে সাধারণ চীনা সৈনিকও একজন মানুষ, তার পায়ে ফোস্কা পড়া অথবা নিজের শহর ও বাড়ির জন্য হাহাকার করা এক তরুণ।
জেমস পামার: উপ-সম্পাদক, ফরেন পলিসি
ফরেন পলিসি অবলম্বনে। অনুবাদ: ইয়াসির আরাফাত।