ডাকসুতে ছাত্র শিবিরের জয় আঁতাত না ম্যাকানিজম?

সামদানী হক নাজুম, ঢাকা
সামদানী হক নাজুম, ঢাকা
ডাকসুতে ছাত্র শিবিরের জয় আঁতাত না ম্যাকানিজম?
ডাকসু ভবন। ছবি: চরচা

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে অভাবনীয় জয় পেয়েছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সহযোগী ইসলামী ছাত্র শিবির সমর্থিত প্যানেল। ভিপি, জিএস, এজিএসসহ ১৫টি সম্পদকীয় পদের মধ্যে ১২টি এবং ১৩টি সদস্য পদের মধ্যে ১১টি পদেই নিকটবর্তী প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে বড় ব্যবধানে জয় পেয়েছে শিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’।

জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা অভিযোগ করেন নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সঙ্গে আঁতাত করে এই জয় পেয়েছে ইসলামী ছাত্র শিবির। তবে ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে চরচা। সেই অনুসন্ধান বলছে, বিশেষ পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগ সমর্থকদের একাংশের ভোট শিবিরের প্রার্থীরা পেলেও এতে কোন আঁতাত ছিল না। জুলাই অভ্যূত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, অভ্যূত্থান পরবর্তী সময়ে ক্যাম্পাসে ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জন এই নির্বাচনে শিবিরকে এগিয়ে রাখে।

গত ৯ সেপ্টেম্বর প্রার্থীদের নানা অভিযোগ পাল্টা অভিযোগে ডাকসু নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শেষে ভোররাতে ফল ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন কমিশন। সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে ৪৫ জন প্রার্থীর মধ্যে ছাত্র শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি মো. আবু সাদিক (সাদিক কায়েম) ১৪ হাজার ৪২ ভোটে নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে অন্য ১২ জন প্রতিদ্বন্দ্বীকে পিছে ফেলে ১০ হাজার ৭৯৪ ভোট পেয়ে সহজ জয় পায় একই সংগঠনের এস এম ফরহাদ হোসেন। ১১ হাজার ৭৭২ ভোট পেয়ে সহ-সাধারণ সম্পাদক(এজিএস) পদে জয় পায় শিবিরের মুহা. মহিউদ্দীন খান। এমনকি মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক পদটিও যায় শিবিরের ঘরেই। এই পদে শিবির সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থী ফাতেমা তাসনিম জুমা নির্বাচিত হন ১০ হাজার ৬৩১ ভোট পেয়ে।

অন্যান্য আলোচিত প্রার্থীদের মধ্যে ভিপি পদে ছাত্রদল সমর্থিত প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান ৫ হাজার ৭০৮ ভোট, স্বতন্ত্র প্রার্থী শামীম হোসেন ৩ হাজার ৮৮৩ ভোট, স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী প্যানেলের প্রার্থী উমামা ফাতেমা পান ৩ হাজার ৩৮৯ ভোট।

জিএস পদে ছাত্রদল সমর্থিত প্রার্থী শেখ তানভীর বারী হামিম ৫ হাজার ২৮৩ ভোট, প্রতিরোধ পর্ষদ প্যানেলের মেঘমল্লার বসু ৪ হাজার ৯৪৯ ভোট, স্বতন্ত্র প্রার্থী আরাফাত চৌধুরী পান ৪ হাজার ৪৪ ভোট। এজিএস পদে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থী তানভীর আল হাদী মায়েদ ৫ হাজার ৬৪ ভোট, স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমীদ আল মুদ্দাসসীর চৌধুরী ৩ হাজার ৮ ভোট পান।

নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর চরচার এক আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপির প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক এ বি এম মোশাররফ হোসেন দাবি করেন ডাকসুতে শিবিরের বিজয়টি মূলত শিবির এবং ছাত্রলীগের যৌথ কার্যক্রমের ফল।

তবে বিএনপি নেতাদের এসব অভিযোগকে শুধু মাত্র পরাজয় এড়ানোর কৌশল হিসেবেই দেখছে ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটি। ইসলামী ছাত্র শিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলামের মতে, ৫ আগস্টের পর ক্যাম্পাসে তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ পায় ছাত্র শিবির। সংগঠন হিসেবে ছাত্র শিবিরের স্বাভাবিক কার্যক্রম আগে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পায়নি সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সারাদেশের ন্যায় ক্যাম্পাসগুলোতেও ছাত্র শিবিরের নামে অপপ্রচার চালিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে ‘জুজুর ভয়’ তৈরি করে রেখেছিল ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগ। কিন্তু ৫ আগস্টের পর শিবিরের সাংগঠনিক কার্যক্রম দেখার পর ছাত্র শিবিরের প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের আস্থা তৈরি হয়।

তিনি বলেন, ‘সাধারণ শিক্ষার্থীরা ট্যাগিং কালচার পছন্দ করে না তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত, বিএনপি নেতারা শিবিরের জয়ের বিপরীতে নিজেদের ব্যর্থতাকে আড়াল করতে গিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছে এবং আওয়ামী লীগের মত ট্যাগিং কালচার আবারও ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে।’ ছাত্রলীগের সঙ্গে কোন আতাঁতের অভিযোগ অস্বীকার করে ছাত্র শিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, ‘জগন্নাথ হলের রেজাল্টইতো এর ভালো জবাব। জগন্নাথ হলকেতো ঢাবি ছাত্রলীগের আঁতুড়ঘর বলা হয়। আঁতাত থাকলে সেখানে সাদিক কায়েম মাত্র ১০ ভোট পায় কীভাবে?’

৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত ক্যাম্পাসে নিজেদের দলীয় এবং সাংগঠনিক পরিচয় গোপন রাখা এবং কোনঠাসা সংগঠনটির কর্মীদের এই আকষ্মিক বিজয়কে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ছাত্র শিবিরের সাংগঠনিক সক্ষমতা এবং অভ্যূত্থান পরবর্তী জনপ্রিয়তা হিসেবে ব্যাখ্যা করলেও, এই ফল এবং নেপথ্য কারণ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তাদের মতে অভ্যুত্থানে ভূমিকার জন্য ছাত্র শিবিরের জনপ্রিয়তা বাড়লেও, একচেটিয়া ভোট পাবার জন্য শুধুমাত্র জনপ্রিয়তা বা সাংগঠনিক শক্তিই যথেষ্ঠ নয়। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং শিক্ষকদের জামায়াত ঘনিষ্টতা, ভোট কারচুপি, অন্যতম ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের প্রতি শিক্ষার্থীদের অনাস্থাসহ নানা করনে শিবিরের ভোট কয়েকগুণ বেড়েছে বলে মনে করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এমনকি বিশেষ পরিস্থিতিতে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগ কর্মী-সমর্থকদের কারও কারও ভোটও শিবিরের প্রার্থীরা পেয়েছেন, যা অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বির বিপরীতে শিবিরের প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান বাড়িয়েছে।

ছাত্রলীগের সমর্থক একজন আবাসিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় চরচার। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তিনি জানান, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর হলগুলোতে মূলত ছাত্র শিবিরের আধিপত্য। এই শিক্ষার্থী সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও সেসময় সমর্থন দিয়েছিলেন ছাত্রলীগকে। এরই ধারাবাহিকতায় ছাত্রলীগ আয়োজিত বিভিন্ন সভা-সমাবেশ-মিছিলে যোগ দিতেন তিনি। কিন্তু অভ্যূত্থান পরবর্তী সময়ে তিনি নিজের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শেষ করতেই ছাত্র শিবিরের সঙ্গে মিলিয়ে চলছেন।

এই শিক্ষার্থী চরচাকে বলেন, ‘আমারতো ঢাকায় থাকার মত জায়গা নেই, হলে থাকি, এই পরিবর্তিত সময়ে এখন আমি কী করব? আমাকে কেউ চাপ দেয়নি তবুও ডাকসু ইলেকশনে আমি নিজের ভোটটা শিবিরকেই দিয়েছি। আমারতো আরও দুই বছর হলে থেকে পড়াশোনা শেষ করতে হবে তাই না?’

ছাত্রলীগের আরও কিছু ভোট শিবির পায় বিএনপির প্রতি ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকে। বিজয় একাত্তর হলের এক আবাসিক শিক্ষার্থী জানান, তার বাবা স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ৫ আগস্টের পর স্থানীয় বিএনপির নেতা কর্মীরা তাদের ঘর-বাড়ি লুট করে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। মামলা হামলার ভয়ে তার বাবা আত্মগোপনে আছেন। অন্য জেলায় আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে মানবেতন জীবন যাপন করছে এই শিক্ষার্থীর মা আর বোন।

তিনি বলেন, ‘আমাদের এলাকার বিএনপি নেতা কর্মীরা আমাদের বাড়িতে আগুন দিয়ে ফেসবুকে উল্লাস করেছে, এগুলো ভুলতে পারি না। আমিতো আমার জীবন থাকতে এই বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখতে চাই না। ডাকসুতে ছাত্রলীগের ক্যান্ডিডেট থাকলে নাহয় তাদের ভোট দিতাম। তাই বাধ্য হয়েই শিবিরকে ভোট দিয়েছি।’

এদিকে চরচার অনুসন্ধানে জানা যায়, ডাকসু নির্বাচনে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে সরাসরি কোন প্রার্থী না থাকলেও প্রায় প্রতিটি পদেই আলাদা আলাদা প্রার্থীদের ছায়া সমর্থন দিয়েছে তারা। ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের ছায়া সমর্থন পাওয়া প্রার্থীদের নাম-পরিচয় নিশ্চিত হয়েছে চরচা। তবে তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে এসব তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না।

অনুসন্ধান বলছে, ডাকসু নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর থেকে শীর্ষ তিনটি পদ ঘিরে পরিকল্পনা করে ছাত্রলীগ নেতারা। তিন পদে তারা আলাদা প্রার্থী দেওয়ার চেষ্টা করে। তবে যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় এবং একজন প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হওয়ায় শেষ সময়ে পুরো পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তাই ভোটের দুইদিন আগে তারা বিভিন্ন প্যানেল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ছায়া সমর্থন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সময় কম থাকায় সব কর্মীদের কাছে সমর্থন দেওয়া প্রার্থীদের তালিকা পৌঁছাতে পারেনি সংগঠনটির সমর্থকরা। তাই ছায়া সমর্থন দেওয়ার পরিকল্পনাটিও ঠিকঠাক কাজে দেয়নি।

এ বিষয়ে কথা হয় ৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে থাকা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের এক শীর্ষ নেতার সঙ্গে। ডাকসু নির্বাচনে একাধিক প্রার্থীদের ছায়া সমর্থন দেওয়ার ঘটনাটি স্বীকার করেন তিনি। একই সঙ্গে শিবিরের সঙ্গে আঁতাত করার যে অভিযোগ তুলেছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা তা অদূরদর্শী ভাবনা বলেও মন্তব্য করেন এই ছাত্রলীগ নেতা। তিনি বলেন, ‘দেখেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নিজস্ব শক্তি আছে। টিকে থাকার জন্য গুপ্ত রাজনীতি বা অন্য দলের সঙ্গে সমঝোতা ছাত্রলীগ করবে না। যারা এটা বলছেন তারা শুধু কথার কথাই বলছেন। শিবির-ছাত্রদল-বাম যাই বলেন না কেন সবাই আমাদের বিরোধী, তারা আমাদের কীভাবে সুবিধা দিবে? তবে আমরা চেয়েছি ডাকসুতে প্রতিনিধি আসুক, যারা ছাত্রলীগের সাধারণ কর্মীদের নিরাপত্তায় হুমকি হবে না। আমাদের কর্মীরা যেন অন্তত পরীক্ষায় বসতে পারে। ছাত্রলীগের এত কর্মীদের শিক্ষাজীবন এভাবে শেষ হতে দেয়া যায় না।”

‘ছাত্রলীগের সঙ্গে আঁতাত করেই জয় পেয়েছে ছাত্র শিবির’ ডাকসু নির্বাচনের পর বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা এমন অভিযোগ তুললেও ছাত্রদল প্যানেলের সহ–সভাপতি (ভিপি) প্রার্থী আবিদুল ইসলাম আবিদের আছে ভিন্ন পর্যবেক্ষণ। তার মতে ছাত্রলীগের সঙ্গে সরাসরি আঁতাত কিংবা ছাত্রলীগের ছায়া সমর্থনে শিবিরের জয় নিশ্চিত হয়নি। তিনি মনে করেন বিপুল ভোটে শিবিরের এই জয়ের পিছনে আরো অনেক বড় ম্যাকানিজম কাজ করেছে।

চরচাকে তিনি বলেন, ‘কিছু প্রার্থীর প্রতি ছাত্রলীগের ছায়া সমর্থন ছিল তা আমরা শুনেছি। তবে আমি মনে করি না ছাত্রলীগের ছায়া সমর্থনের কারণে ফলাফলে এত পার্থক্য হয়েছে। এরপর সোমবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়র মধুর ক্যান্টিনে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ডাকসু নির্বাচনে ১১টি অনিয়মের অভিযোগ তুলে ধরেন আবিদুল ইসলাম আবিদ।

সম্পর্কিত