চরচা ডেস্ক

নদী ভাঙন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষের অন্যতম দুর্যোগ। এই দুর্যোগের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে উত্তরবঙ্গ। নদীভাঙনে এ অঞ্চলের মানুষ হারাচ্ছে ঘরবাড়ি, জমি, ফসল এমনকি গবাদিপশুও। একসময় লাখো মানুষের জীবনের অবলম্বন ছিল ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও ধরলা। আর এ নদীগুলোই হয়ে উঠেছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তার প্রতীক।
কুড়িগ্রামের কৃষক নুরুন নবীর ঘরটি এক বছরের মধ্যে আবার ভাঙা হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র নদীর ভাঙনের ভয়ে টিকতে না পেরে তাকে সরতে হচ্ছে নতুন ঠিকানায়। এক বছরের মধ্যেই দ্বিতীয়বারের মতো বসত সরাচ্ছেন চার সন্তানের পিতা নুরুন নবী।
৫০ বছর বয়সী নবীকে যেতে হচ্ছে আরেক চরে। সেই চরও আবার নদীর পলিতে তৈরি অস্থায়ী ভূমি। এরইমধ্যে তলিয়ে গেছে ধান ও মসুর ডালের ক্ষেত। নবী জানান, নদী ভাঙনে ঘর সরানো এক প্রকার তাদের পেশায় পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, “আমার এক জীবনে এই নিয়ে ৩১ বার ঘর টানলাম।”
প্রতিবছর কুড়িগ্রাম জেলার শত শত পরিবার নবীর মতো একই পরিস্থিতিতে পড়ে। উত্তরাঞ্চলের এসব বালুময় ও ভঙ্গুর চরগুলো বাংলাদেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম। পরিবারগুলো একের পর এক ঘর তোলে, আর নদী কেড়ে নেয় তাদের সবকিছু।
উজানে বসরবাসকারী ৩৩ বছর বয়সী জহুরুল আলী অবশ্য কিছুটা ভাগ্যবান। মূল ভূখণ্ডে কিছুদিন পড়াশোনা করার সুযোগ হয়েছিল তার। পরে জলবায়ু কর্মী ও কয়েকটি দাতব্য সংস্থার সহায়তায় তিনি জিওব্যাগ ব্যবহার করে ভাঙনের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন।

গত তিন বছর ধরে তার চর টিকে আছে সেই প্রচেষ্টায়। নদী ভাঙনের দুরাবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “নদী ভাঙ্গা মানুষের যে কষ্ট, আসলে আমরা আমাদের বাপ-দাদার যে কবরটা দিয়েছি, সে জায়গাটাও কিন্তু আমাদের নেই এখন।”
জহুরুল ও তার প্রতিবেশীরা মিলে চরের শিশুদের জন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও গড়ে তুলেছেন, যেখানে স্বেচ্ছাসেবীরা পড়ান।
নদী ভাঙন নতুন কোনো ঘটনা নয়, তবে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, আগে চরের অবস্থান ছিল তুলনামূলক স্থিতিশীল। এখন অনিয়মিত বৃষ্টি ও নদীর গভীরতার পরিবর্তনে সমস্যা বেড়েছে বহুগুণ।
পরিবেশ বিশ্লেষক ও সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস)-এর নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা এ খান বলেন, “পুরো নদীজুড়ে চর গঠন ও ভাঙন কমছে না মূলত দুটি প্রধান কারণে।
প্রথমত, বিপুল পরিমাণ পলি জমা হচ্ছে নদীতে; দ্বিতীয়ত, নদীর তলদেশের ঢাল উজানের তুলনায় অত্যন্ত সমতল। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের নদীতীর ও নদীভাঙন প্রক্রিয়ায় বড় প্রভাব ফেলছে। কারণ নদী তীর ক্ষয় ও পলি সঞ্চয়ের প্রক্রিয়া মূলত পানির প্রবাহের ওপর নির্ভরশীল। ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বা প্রবাহের ধরনে কোনো পরিবর্তন ঘটলে, সেটি সরাসরি নদী তীর ভাঙন ও পলি জমার গতিকে প্রভাবিত করে।”
তিনি আরও জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের আরেক গুরুত্বপূর্ণ কারণ নগরায়ণ। যদি যমুনা নদীর উজান অংশে নগরায়ণ বৃদ্ধি পায়, তাহলে তার ফলে পলির পরিমাণ এবং পানির প্রবাহ উভয়ই বেড়ে যায়। এর ফলেই নদীর গতি ও চরভূমির ভাঙন-গঠনের প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত হয়।

স্থানীয় বাসিন্দারা এসব চরাঞ্চলের উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি জানিয়েছেন।
বিশ্বের দৃষ্টি যখন আজ থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত কপ ৩০ জলবায়ু সম্মেলনের দিকে, তখন বাংলাদেশের এই সংগ্রাম বিশ্বনেতাদের জন্য এক সতর্ক বার্তা।
বাঁধ নির্মাণ, আবহাওয়ার পূর্বাভাসের উন্নতি এবং স্থানীয় পর্যায়ে অভিযোজনমূলক উদ্যোগ নিয়ে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার মোকাবিলা করে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সেজন্য বাংলাদেশকে টিকে থাকার থাকার দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রায়ই তুলে ধরা হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার না হলে যে সেই সাফল্য স্থায়ী হবে না, সেই বাস্তবতাই যেন তুলে ধরছে উত্তরবঙ্গের চরবাসীর প্রতিদিনের জীবন।

নদী ভাঙন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষের অন্যতম দুর্যোগ। এই দুর্যোগের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে উত্তরবঙ্গ। নদীভাঙনে এ অঞ্চলের মানুষ হারাচ্ছে ঘরবাড়ি, জমি, ফসল এমনকি গবাদিপশুও। একসময় লাখো মানুষের জীবনের অবলম্বন ছিল ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও ধরলা। আর এ নদীগুলোই হয়ে উঠেছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তার প্রতীক।
কুড়িগ্রামের কৃষক নুরুন নবীর ঘরটি এক বছরের মধ্যে আবার ভাঙা হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র নদীর ভাঙনের ভয়ে টিকতে না পেরে তাকে সরতে হচ্ছে নতুন ঠিকানায়। এক বছরের মধ্যেই দ্বিতীয়বারের মতো বসত সরাচ্ছেন চার সন্তানের পিতা নুরুন নবী।
৫০ বছর বয়সী নবীকে যেতে হচ্ছে আরেক চরে। সেই চরও আবার নদীর পলিতে তৈরি অস্থায়ী ভূমি। এরইমধ্যে তলিয়ে গেছে ধান ও মসুর ডালের ক্ষেত। নবী জানান, নদী ভাঙনে ঘর সরানো এক প্রকার তাদের পেশায় পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, “আমার এক জীবনে এই নিয়ে ৩১ বার ঘর টানলাম।”
প্রতিবছর কুড়িগ্রাম জেলার শত শত পরিবার নবীর মতো একই পরিস্থিতিতে পড়ে। উত্তরাঞ্চলের এসব বালুময় ও ভঙ্গুর চরগুলো বাংলাদেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম। পরিবারগুলো একের পর এক ঘর তোলে, আর নদী কেড়ে নেয় তাদের সবকিছু।
উজানে বসরবাসকারী ৩৩ বছর বয়সী জহুরুল আলী অবশ্য কিছুটা ভাগ্যবান। মূল ভূখণ্ডে কিছুদিন পড়াশোনা করার সুযোগ হয়েছিল তার। পরে জলবায়ু কর্মী ও কয়েকটি দাতব্য সংস্থার সহায়তায় তিনি জিওব্যাগ ব্যবহার করে ভাঙনের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন।

গত তিন বছর ধরে তার চর টিকে আছে সেই প্রচেষ্টায়। নদী ভাঙনের দুরাবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “নদী ভাঙ্গা মানুষের যে কষ্ট, আসলে আমরা আমাদের বাপ-দাদার যে কবরটা দিয়েছি, সে জায়গাটাও কিন্তু আমাদের নেই এখন।”
জহুরুল ও তার প্রতিবেশীরা মিলে চরের শিশুদের জন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও গড়ে তুলেছেন, যেখানে স্বেচ্ছাসেবীরা পড়ান।
নদী ভাঙন নতুন কোনো ঘটনা নয়, তবে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, আগে চরের অবস্থান ছিল তুলনামূলক স্থিতিশীল। এখন অনিয়মিত বৃষ্টি ও নদীর গভীরতার পরিবর্তনে সমস্যা বেড়েছে বহুগুণ।
পরিবেশ বিশ্লেষক ও সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস)-এর নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা এ খান বলেন, “পুরো নদীজুড়ে চর গঠন ও ভাঙন কমছে না মূলত দুটি প্রধান কারণে।
প্রথমত, বিপুল পরিমাণ পলি জমা হচ্ছে নদীতে; দ্বিতীয়ত, নদীর তলদেশের ঢাল উজানের তুলনায় অত্যন্ত সমতল। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের নদীতীর ও নদীভাঙন প্রক্রিয়ায় বড় প্রভাব ফেলছে। কারণ নদী তীর ক্ষয় ও পলি সঞ্চয়ের প্রক্রিয়া মূলত পানির প্রবাহের ওপর নির্ভরশীল। ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বা প্রবাহের ধরনে কোনো পরিবর্তন ঘটলে, সেটি সরাসরি নদী তীর ভাঙন ও পলি জমার গতিকে প্রভাবিত করে।”
তিনি আরও জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের আরেক গুরুত্বপূর্ণ কারণ নগরায়ণ। যদি যমুনা নদীর উজান অংশে নগরায়ণ বৃদ্ধি পায়, তাহলে তার ফলে পলির পরিমাণ এবং পানির প্রবাহ উভয়ই বেড়ে যায়। এর ফলেই নদীর গতি ও চরভূমির ভাঙন-গঠনের প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত হয়।

স্থানীয় বাসিন্দারা এসব চরাঞ্চলের উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি জানিয়েছেন।
বিশ্বের দৃষ্টি যখন আজ থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত কপ ৩০ জলবায়ু সম্মেলনের দিকে, তখন বাংলাদেশের এই সংগ্রাম বিশ্বনেতাদের জন্য এক সতর্ক বার্তা।
বাঁধ নির্মাণ, আবহাওয়ার পূর্বাভাসের উন্নতি এবং স্থানীয় পর্যায়ে অভিযোজনমূলক উদ্যোগ নিয়ে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার মোকাবিলা করে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সেজন্য বাংলাদেশকে টিকে থাকার থাকার দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রায়ই তুলে ধরা হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার না হলে যে সেই সাফল্য স্থায়ী হবে না, সেই বাস্তবতাই যেন তুলে ধরছে উত্তরবঙ্গের চরবাসীর প্রতিদিনের জীবন।