‘পাকিস্তানি সেনাদের ধর্ষণের ব্ল্যাঙ্কচেক দেওয়া হয়েছিল’

চরচা প্রতিবেদক
চরচা প্রতিবেদক
‘পাকিস্তানি সেনাদের ধর্ষণের ব্ল্যাঙ্কচেক দেওয়া হয়েছিল’

স্বাধীনতা যুদ্ধের পরপরই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বাংলাদেশ সরকারের। অর্থ নেই, সম্পদ নেই, প্রতিষ্ঠান নেই—এমন পরিস্থিতিতে যেকোনো ধরনের পুনর্গঠন কিংবা পুনর্বাসনই ছিল সরকারের জন্য কঠিন, এর মধ্যেই সদ্য স্বাধীন দেশ মুখোমুখি হয় ভয়াবহ এক সামাজিক সমস্যার। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনা সদস্যদের হাতে ধর্ষণের শিকার হন লাখো বাঙালি নারী। সেই নির্যতনের ফসল ছিল অগণিত যুদ্ধশিশু। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ধর্ষণের শিকার নারীদের সামাজিক অবস্থান নিয়ে দেখা দেয় ভয়ংকর সমস্যা। সেটি এমন একটা সমস্যা ছিল, যেটি সমাধান জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছিল সরকারের কাছে। এ নিয়ে সৃষ্ট সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক আর চিকিৎসা সংক্রান্ত জটিল পরিস্থিতি সমাধানে সরকার ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন সংস্থা। এই সংস্থা মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন, যুদ্ধ শিশুদের সামাজিক মর্যাদার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। নির্যাতিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল। তাদের জন্য প্রশিক্ষণ, তাদের স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল।

এর পাশাপাশি আরও একটি সমস্যার ব্যাপারে তারা দৃষ্টি দিয়েছিল। আজ থেকে ৫৪ বছর আগের সামাজিক প্রেক্ষাপটে সেটি ছিল বিরাট সমস্যা। সামাজিক সমস্যা। মানবিক সমস্যা।

১৬ ডিসেম্বরের পর যুদ্ধবন্দী পাকিস্তানি সেনাদের মধ্য ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন নিয়ে কোনো অনুতাপ ছিল না। ছবি: সংগৃহীত
১৬ ডিসেম্বরের পর যুদ্ধবন্দী পাকিস্তানি সেনাদের মধ্য ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন নিয়ে কোনো অনুতাপ ছিল না। ছবি: সংগৃহীত

১৯৭২ সালের মার্চে নির্যাতিত নারীদের গর্ভপাত ও স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশে এসেছিলেন অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক জিওফ্রে ডেভিস। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত তিনি ছিলেন। নিজের উদ্যোগেই এসেছিলেন। প্রথমদিকে এ ব্যাপারে কোনো পৃষ্ঠপোষক না পেলেও পরবর্তীতে তাঁকে সহায়তা করেছিল ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান্ড ফাদারহুড, ইউএনএফপিএ এবং ডব্লিউএইচও। নিজের চোখে দেখেছেন নির্যাতিতদের অবস্থা। একই সঙ্গে গর্ভপাতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের বাস্তব সমস্যারও মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাঁকে। কিছু সমস্যা ছিল আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটের। তিনি বাংলাদেশে তাঁর অবস্থানকালীন অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন ‘দ্য চেঞ্জিং ফেস অব জেনোসাইড’ নামের এক লেখায়। তিনি লিখেছেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশে সরকার নির্যাতিত ও ধর্ষণের শিকার নারীদের নিয়ে খুব অসহায় অবস্থায় ছিল। সরকার আবিষ্কার করল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অবকাঠামো পুনর্গঠনের আর্থিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে আরেকটি বড় সামাজিক সমস্যা। দেশে বড় সংখ্যক কুমারী গর্ভবর্তী, যাদের বেশিরভাগের বয়সই কুড়ি পেরোয়নি। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাহায্য চাওয়া হলো। দেশে গর্ভপাত কর্মসূচি নেওয়া হলো। দেখা গেল দেশটির আইনি ব্যবস্থা প্রতিকূলে। জনসংখ্যা নিয়ে হিমশিম খাওয়া দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ, যাদের পেনালকোডে তখনও ৩১২ ও ৩১৩ ধারা বলবৎ। যেটি গর্ভপাতকে আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে অপরাধের পর্যায়ে ফেলছে। ১৮৬১ সালে প্রবর্তিত ব্রিটিশ আইনের ৫৮ ও ৫৯ ধারাই এগুলো।’

তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় নারী নির্যাতনের প্রেক্ষাপট নিয়ে নিজের অভিমত তুলে ধরেছেন সেই লেখায়, ‘বাঙালিদের দাবিয়ে রাখতে ও বাংলাদেশে নিজেদের অধিকারবোধ টিকিয়ে রাখতেই নারী ধর্ষণের পরিকল্পনা করেছিল পাকিস্তানি সেনা। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তরে ধর্ষনের ব্ল্যাঙ্ক চেক দেওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্যটা ছিল বিবাহিত হোক কিংবা কুমারী, যত বেশিসংখ্যক বাঙালি মেয়েকে গর্ভবতী করা এটা দিয়ে তারা বাঙালির জাতীয়তাবোধের অহমে আঘাত করতে চেয়েছিল। সেই অহম ভেঙে চুরে দিতে চেয়েছিল। চেয়েছিল শঙ্কর জাত সৃষ্টি করতে।’

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা নির্যাতিত নারী ও যুদ্ধশিশুদের নিয়ে কাজ করেছিলেন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি গবেষক চিকিৎসক বীনা ডি’কস্তা। তিনি জিওফ্রে ডেভিসের একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন নিজের গবেষণার অংশ হিসেবে। তাঁকে ডা. ডেভিস সবচেয়ে ভয়ংকর যে তথ্যটি দিয়েছিলেন সেটি হলো, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষণের শিকার নারীদের যে সংখ্যাটি বাংলাদেশে স্বীকৃত, সেটি বাস্তবতার চেয়ে অনেক কম। সংখ্যাটা তার চেয়ে অনেক বেশি।’

অস্ট্রেলীয় চিকিৎসব জিওফ্রে ডেভিস
অস্ট্রেলীয় চিকিৎসব জিওফ্রে ডেভিস

তিনি বীনা ডি’কস্তাকে নিজের কাজের পরিধির একটা বর্ণনা দিয়েছিলেন, ‘সেনা ক্যাম্পে আটক অবস্থায় নারীদের ধর্ষণ করা হতো। সেই অবস্থায় যে শিশুরা জন্মেছিল, তাদের বাঁচানোই ছিল আমার প্রথম কাজ। একই সঙ্গে গর্ভের শিশুদের যারা রাখতে চাইত না, সেটিও দেখতে হতো। জন্মানোর পর অনেক শিশুই ভুগত ভয়ংকর অপুষ্টিতে। মায়ের স্বাস্থ্যগত কারণে জন্মানো শিশুরা হতো রুগ্ন। অনেক নারীকে গর্ভপাতে রাজি করাতে হতো। গর্ভপাত করতে গিয়ে আইনি সমস্যায় পড়তে হয়েছে। গর্ভপাতের সুবিধাও ঢাকা ছাড়া দেশের অন্য অঞ্চলে সেভাবে ছিল না। নির্যাতিত নারী ও যুদ্ধশিশুদের সামাজিক পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত করা ছিল বড় কঠিন কাজ।’

নারী ধর্ষণের মাধ্যমে পাকিস্তানিরা বাঙালির জাতীয়তাবোধের অহমে আঘাত দিতে চেয়েছিল। ছবি: প্রতীকী
নারী ধর্ষণের মাধ্যমে পাকিস্তানিরা বাঙালির জাতীয়তাবোধের অহমে আঘাত দিতে চেয়েছিল। ছবি: প্রতীকী

যুদ্ধ শিশুদের সামাজিক প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ডা. ডেভিসের কথা, ‘শিশুদের পুনর্বাসনের বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর। একটি কারণ এই যে পাকিস্তান ছিল কমনওয়েলথভুক্ত দেশ এবং তাদের বেশির ভাগ কর্মকর্তারই প্রশিক্ষণ হয়েছিল ইংল্যান্ডে। ফলে বিষয়টি ব্রিটিশ সরকারের জন্যও বিব্রতকর ছিল।’

যুদ্ধবন্দী এক পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার সঙ্গেও এ বিষয়ে কথা বলেছিলেন ডেভিস। সেই পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা যে মন্তব্য করেছিলেন, তাতে তিনি হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। সেই পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার মন্তব্য ছিল, ‘যুদ্ধে তো কত কিছুই হয়! আমরা এমন কী করেছি! এসব তো যুদ্ধে হয়েই থাকে। সব যুদ্ধেই হয়।’

ডেভিসকে সবচেয়ে অবাক করেছিল পাকিস্তানিদের মনস্তত্ত্ব। নারী ধর্ষণকে তারা যুদ্ধের ময়দানে জায়েজ মনে করত। এ ব্যাপারে কোনো ধর্মীয় বিধিনিষেধ নিয়ে তাদের ভয় ছিল না। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত, ধর্ষণের পর যে শিশুটির জন্ম হবে, তার শরীরে থাকবে পাঞ্জাবি, পশতুন, বালুচি কিংবা সিন্ধি রক্ত। মোটকথা, পশ্চিম পাকিস্তানি রক্ত। এরা হবে বিশুদ্ধ। এমন একটা প্রজন্ম তৈরি হবে, যারা নিজেদের বাবার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে সাহস পাবে না।’

সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমসে Dacca Raising the Status of Women While Aiding Rape Victims নামের প্রতিবেদন। যেটি ছাপা হয়েছিল ১৯৭২ সালের ১২ মে।

ড. বীনা ডি কস্তার গবেষণাপত্র নিয়ে প্রকাশিত বই নেশন বিল্ডিং জেন্ডার অ্যান্ড ওয়ার ক্রাইম ইন সাউথ এশিয়া

ডা. জিওফ্রে ডেভিসের বাংলাদেশ–অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা প্রবন্ধ দ্য চেঞ্জিং ফেস অব জোনোসাইড

সম্পর্কিত