ওসমান হাদি হত্যা ও এর প্রতিক্রিয়া–দুইই কি একসূত্রে গাঁথা?

ওসমান হাদি হত্যা ও এর প্রতিক্রিয়া–দুইই কি একসূত্রে গাঁথা?
ওসমান হাদি। ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

ইনকিলাব মঞ্চের শরিফ ওসমান হাদি আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে জানাজার পর তার দাফনও সম্পন্ন হয়েছে। ওসমান হাদির মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় একটা তাণ্ডবও হয়ে গেছে দেশে। এসবই এখন পুরোনো খবর। এ নিয়ে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এখনো চলছে। কিন্তু এইসব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বড় কিছু প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেছে।

প্রশ্নটি সহজ– হাদির হত্যাকারী, তার নির্দেশদাতা এবং হাদি হত্যাকাণ্ডে সংক্ষুব্ধদের উদ্দেশ্য কি কোনো জায়গায় মিলে যাচ্ছে? তারা কি একই লক্ষ্যের অভিমুখে এগিয়ে যাচ্ছেন?

একটু ব্যাখ্যা করা যাক। গত ১২ ডিসেম্বর ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি নির্বাচনের প্রচারকাজে বেরিয়েছিলেন। রাজধানীর পল্টন এলাকায় জুমার নামাজের পর প্রচার শেষে ফিরছিলেন তিনি। অটোরিকশায় থাকা হাদিকে গুলি করে চলে যান মোটরসাইকেল আরোহী দুজন। এই হত্যাকারী (তখন পর্যন্ত হামলাকারী) শনাক্ত করতে রীতিমতো গলদঘর্ম হয়েছে পুলিশ। এমনকি সিসিটিভি ফুটেজে শনাক্ত করা মোটরসাইকেলের মালিক খুঁজতে গিয়েও ভুল ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কারণ, তারা মোটরসাইকেলের নম্বরপ্লেট শুধু নয়, মডেলও ভুল করেছিল। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা সংশ্লিষ্ট কারও কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়ার আগেই একের পর এক তথ্য প্রকাশ পাচ্ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এমনকি সরকারের তরফ থেকেও এ সম্পর্কিত বিবৃতি বা ভাষ্যটি আমরা পেয়েছি সোশ্যাল মিডিয়াতেই।

এ তো গেল প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বপ্রাপ্ত অংশের আচরণ। বিপরীতে আরেকটি কাজ চলছিল। আর তা হলো অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ। প্রথমেই আঙুল উঠল হাদির সম্ভাব্য নির্বাচনী এলাকা ঢাকা-৮ এ বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী মির্জা আব্বাসের দিকে। আর এ আঙুল তুললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি সাদিক কায়েম, যিনি আবার একই আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীও। মজার বিষয় হচ্ছে, এই প্রসঙ্গে কেউ জোর দিয়ে বলল না যে, হাদির জনপ্রিয়তা যদি মির্জা আব্বাসের মাথাব্যথার কারণ হয়, তবে সেই মাথাব্যথা তো সাদিক কায়েমেরও হওয়ার কথা। বরং, একটু বেশিই হওয়ার কথা। কারণ, হাদির জনপ্রিয়তার ভিত্তি ও সাদিক কায়েমের জনপ্রিয়তার ভিত্তি প্রায় একই।

এটা রাজনীতির একটা দিক। আরেকটি দিকও আছে। বলা হলো– গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা হারানো এবং বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগ নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা আগেই দিয়ে রেখেছে। সুতরাং আওয়ামী লীগই হাদির হত্যায় জড়িত। এই অনুমান বা এমন অভিযোগের পেছনে জোরদার যুক্তিও রয়েছে। কারণ, হাদির ওপর হামলার আগের দিনই আসন্ন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।

শরিফ ওসমান হাদি। ছবি: সংগৃহীত
শরিফ ওসমান হাদি। ছবি: সংগৃহীত

কিন্তু আগ্রহ নিয়ে তাকাতে হয়, যখন দেখা যায়, আসন্ন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে–এমন কয়েকটি পক্ষের কাছ থেকেও এই ভাষ্য আসে যে, হাদির ওপর হামলা প্রমাণ করে যে, নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। এ অবস্থায় নির্বাচন করা যাবে না।

যে সময়ে হাদির ওপর হামলার বিচার দাবি মুখ্য হয়ে ওঠার কথা, যে সময়ে হাদির সুস্থ হয়ে ফেরা নিয়ে সবার বিচলিত থাকার কথা, যে সময়ে একটা পূর্ণাঙ্গ তদন্ত এবং তার ফল হিসেবে কারা এর পেছনে আছে, তা খুঁজে বের করতে চাপ প্রয়োগের কথা, সে সময়ে দেখা গেল রাজনৈতিক পক্ষগুলো খুবই বিচিত্রভাবে কাজ করছে। এক পক্ষ সরাসরি বিএনপির দিকে আঙুল তুলছে, এবং এর মধ্য দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে রীতিমতো আদালত বসিয়ে রায় দিয়ে দিচ্ছে যে, ওই আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীই আসলে এই অপকর্মের পেছনে আছেন। আরেক পক্ষ নিরাপত্তা শঙ্কার কথা তুলে নির্বাচনই পিছিয়ে দেওয়ার কথা বলছে। দুটি ক্ষেত্রেই উদ্দেশ্য কি এক নয়?

একটু খোলাসা করা যাক। আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমর্থক, কর্মীবাহিনী ইত্যাদি নানা বিবেচনায় দেশের সবচেয়ে বড় দল এই মুহূর্তে নিঃসন্দেহে বিএনপি। ফলে আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হতে পারে বলে সাধারণ একটি অনুমান রয়েছে রাজনীতির মাঠে। এ কারণে কোনো একটি আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার নাম জড়িয়ে দেওয়া, আর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে নির্বাচন পেছানোর ডাক দেওয়া আসলে একই মুদ্রার এপিঠ–ওপিঠ বললে কি খুব একটা অত্যুক্তি হবে?

এবার আসা যাক, হাদির মৃত্যুর খবর পাওয়া পর হওয়া অভাবিত প্রতিক্রিয়ার প্রসঙ্গে। ১৮ ডিসেম্বর রাত ১০টার দিকে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন শরিফ ওসমান হাদি মারা গেছেন বলে নিশ্চিত খবর আসে। সেই খবরের পর তার অনুসারী ও ভক্তরা শোক মিছিল বের করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ শুরু হয়। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন বলে আমরা জানতে পারি। অনুমিতভাবেই প্রধান উপদেষ্টা হাদির মৃত্যুতে গভীর শোক জানান। এবং সংযুক্তি হিসেবে তিনি সবাইকে ‘শান্ত ও সংযত’ থাকার আহ্বান জানান। যদিও তখন পর্যন্ত কোনো ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনার কথা আমরা জানতে পারিনি।

হাদির মারা যাওয়ার খবরের পর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধান উপদেষ্টা। ছবি: টিভি থেকে স্ক্রিনশট
হাদির মারা যাওয়ার খবরের পর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধান উপদেষ্টা। ছবি: টিভি থেকে স্ক্রিনশট

বিক্ষোভ ও শোকমিছিল হচ্ছিল। সামাজিক মাধ্যমে বহু মানুষ শোক জানাচ্ছিলেন। এটা তো হওয়ারই কথা। কিন্তু কেন কোনো অঘটন হবে বোঝা যাচ্ছিল না। ফলে প্রধান উপদেষ্টার ‘শান্ত ও সংযত থাকার’ আহ্বানকে সতর্কতা হিসেবে পাঠ করা গেছে। আবার একটা কু ডাকও ডাকছিল যে, তবে কি প্রশাসন এমন কিছু হতে পারে বলে গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছে?

সে যাই হোক, প্রধান উপদেষ্টা তো সতর্ক বার্তা দিয়েছেন। নিশ্চয় পদক্ষেপও নিয়েছেন। কিন্তু বিস্মিত হয়ে দেখা গেল যে, সতর্কবার্তা থাকলেও কোনো পদক্ষেপ ছিল না। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের প্রধান কার্যালয় আক্রান্ত হলো। ছায়ানট ভবন আক্রান্ত হলো। এই হামলা চলল। আগুন লাগল। সেখানে কর্মরতরা আতঙ্ক নিয়ে আগুনের আঁচ পেলেন। কিন্তু সহায়তা পৌঁছাল না। পৌঁছাল, তবে অনেক পরে। আমরা ব্যাকরণ বই উল্টে আবারও পড়তে শুরু করলাম–‘ডাক্তার আসিবার আগে রোগী মারা গেল’–এর মতো করে পাঠ করলাম ‘আর্মি-পুলিশ আসিবার অনেক পূর্বে পুড়িয়া সব ভস্ম হইল’। এ যেন বাংলা সিনেমার সেই দৃশ্য–যেখানে মেরে প্রায় সব সাফ করে দেওয়ার পর পুলিশ এসে মিহি গলায় বলে–‘না না, আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না।’

তাকানো যাক আরেক দিকে। হাদির মৃত্যুসংবাদ যেদিন আসে, সেই ১৮ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের ভালুকায় ‘ধর্ম অবমাননার’ অভিযোগ তুলে দিপু চন্দ্র দাস নামের এক ২৮ বছর বয়সী পোশাক শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার পর গাছের সঙ্গে বেঁধে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তীব্র সমালোচনার মুখে ২০ ডিসেম্বর ১০ জনকে আটক করা হয়। আটককারী সংস্থা র‍্যাব জানায়, ধর্ম অবমাননার যে অভিযোগ, তা সম্পর্কে যারা পিটিয়ে দিপুকে হত্যা করেছে তারা কেউ কিছু জানে না। কেউ বলতে পারেনি দিপু ঠিক কী বলেছিলেন? অথচ আমরা দেখলাম একদল লোক দিপুকে পিটিয়ে মারল, তাকে পোড়ালো এবং সেই হত্যাদৃশ্য নিজ নিজ মোবাইলে ধারণ করল। মোবাইলে ধারণ করতে করতে আগুন যেন না নেভে, তার ব্যবস্থা করল। এই দৃশ্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর আমরা পুলিশকে বলতে শুনি-দিপুর পরিবারের কেউ মামলা করেনি। মামলা করলে তারা ব্যবস্থা নেবে। অথচ এমন অনেক উদাহরণ আছে যেসব মামলার বাদী রাষ্ট্র নিজেই।

প্রশ্ন হলো-দিপুকে কে হত্যাযোগ্য করেছে? উত্তর খুঁজতে গেলে সরাসরি প্রশাসনের কথা বলতে হয়। কারণ, এর আগে নুরাল পাগলার লাশ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে ফেলতে আমরা দেখেছি। আমরা দেখেছি ‘ধর্ম অবমাননা’ মতো অভিযোগ তুলে একের পর এক মানুষকে আক্রান্ত হতে। কিন্তু প্রশাসন? অন্তর্বর্তী সরকার বিবৃতিসর্বস্ব সরকার হয়ে শুধু কথা বলেছে। তাও আবার এর অধিকাংশই সামাজিকমাধ্যমে দেওয়া পোস্টে।

দিপু চন্দ্র দাস। ছবি: সংগৃহীত
দিপু চন্দ্র দাস। ছবি: সংগৃহীত

একমাত্র আলাদা করে যদি কারও কথা বলতে হয়, তাহলে মাহফুজ আলমের কথা বলতে পারা যায়। কিন্তু তিনিও তথ্য উপদেষ্টা থাকাকালে মাজার নিয়ে বা বিভিন্ন আক্রমণাত্মক ঘটনার সময় সুস্পষ্ট অবস্থান ধরে রাখতে পারলেও হাদির ওপর হামলার পর ‘লাশের বদলে লাশ’ নেওয়ার কথা বলেছেন প্রকাশ্য বক্তৃতায়।

একই দিনে আমরা তাকাতে পারি খুলনার দিকে। সেখানে স্থানীয় সাংবাদিক ইমদাদুল হক মিলনকে গুলি করে হত্যা করে ‘দুর্বৃত্ত’ অভিধাপ্রাপ্ত কিছু লোক। পুলিশ এখনো এর কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি। পারবে কি শেষ পর্যন্ত-প্রশ্ন থেকে যায়।

সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে ব্যক্তি সাংবাদিক, কিংবা প্রশ্ন তুলতে পারে এমন যেকোনো ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান এই সময়ে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে নানা সময়ে নাগরিক সমাজসহ নানা ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে উদ্বেগ জানানো হলেও অন্তর্বর্তী সরকার, তার প্রশাসন অনেকটা জড়ভরত হয়ে থেকেছে। যদিওবা কিছু বলেছে, তাও অনেকটা ভিকটিম ব্লেমের মতো করে, যা মব নামক বিষয়টিকে প্রকারান্তরে উৎসাহ দিয়ে গেছে। এখানেও সেই পুরোনো বিষয়টিই সামনে আসে-আইনের দফারফা করার পর আমরা শুনতে পাই আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার কর্তৃপক্ষীয় বাণী, ঠিক যেমন রাজধানীতে দুই শীর্ষ সংবাদমাধ্যম পুড়িয়ে ফেলার পর আমরা শুনেছি।

এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া পোস্টটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি পরিষ্কার করে বলেছেন, “গত রাতে দ্যা ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোতে সাংবাদিক বন্ধুদের কাছ থেকে চিৎকার, কান্নাভেজা কল পেলাম। সকল বন্ধুদের কাছে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি।”

শফিকুল আলম সাহায্য করতে পারে এমন জায়গাগুলোতে একের পর এক কল করেও সময়মতো সহায়তা পৌঁছাতে পারেননি বলে তার পোস্টে উল্লেখ করেছেন। এই লজ্জা থেকে তিনি এমনকি মাটির নিচে নিজের মুখ লুকাতেও চেয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে–এমনকি এই ভাষ্যটি আসতে ১২ ঘণ্টার বেশি সময় লাগল কেন? প্রধান উপদেষ্টার সতর্কবার্তা কি তাহলে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী?

সাথে যৌক্তিকভাবেই এই প্রশ্ন সামনে আসে যে, এই এখন শফিকুল আলম যে দুঃখ প্রকাশ করছেন, যে কাণ্ড দেখে তিনি মুখ লুকাতে চাইছেন, এমন কাণ্ডের হোতাদেরই তো তিনি একসময় ‘প্রেশার গ্রুপ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি তখন এই ‘প্রেশার গ্রুপ’কে যারা ‘মব’ বা ‘দঙ্গল’ বলছিল, তাদের মৃদু তিরষ্কারও কি করেননি?

মনে পড়ছে না? একটু পেছনে তাকানো যাক। গত ২৬ জুন রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা: সাংবাদিকদের সুরক্ষা ও আইন বিশ্লেষণ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভার আয়োজন করে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস)। সেখানে ডেইলি স্টারের সামনে গরু জবাই-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে শফিকুল আলম বলেন, “এটা মব নয়, এটা প্রেশার। যারা দীর্ঘদিন ধরে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কারণ তারা দেখছে, পুরোনো ধারার সাংবাদিকতা এখনো চলছে।”

লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, আয়োজনটি ছিল গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের সুরক্ষা বিষয়ে। সেই আয়োজনে বক্তব্য দেওয়া এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা শফিকুল আলমের কাছে ডেইলি স্টারের সামনে জেয়াফত করাটাকে ‘মব’ মনে হয়নি। তিনি সম্ভবত সে সময় নিজের পুরোনো সাংবাদিক পরিচয়টি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। অবশ্য আমরা জাতি হিসেবেই মনভোলা। এটা তার দোষ নয় নিশ্চয়।

অতঃপর? বলতেই হয় যে, ‘এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে’। কারণ কী? প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব ২০ ডিসেম্বর গভীর রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট করেছেন। তিনি সেখানে বলেছেন, “সন্ত্রাস ও সহিংসতার আহ্বান সম্বলিত যেকোনো সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট আগামীকাল থেকে সরাসরি রিপোর্ট করুন।” সেখানে তিনি একটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর এবং একটি সরকারি ই-মেইল ঠিকানাও দিয়েছেন। মনে করিয়ে দিয়েছেন বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়িয়ে সহিংসতা উসকে দেওয়াটা দণ্ডনীয় অপরাধ।

হাদির মৃত্যুর খবরে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয় প্রথম আলো ভবনে। ছবি: চরচা
হাদির মৃত্যুর খবরে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয় প্রথম আলো ভবনে। ছবি: চরচা

প্রশ্ন আসতেই পারে যে, এতদিন কোথায় ছিলেন? হায়, জীবনানন্দের কবিতার লাইন কতভাবেই না ব্যবহার করতে হয়। বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করতে হয়-এতদিনে, এত এত দিনে! একই প্রশ্নময় চোখে তাকাতে হয় সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর দিকে, যখন বিধ্বস্ত ছায়ানট ভবন পরিদর্শেন গিয়ে তিনি বলেন, সিসিটিভি ফুটেজ দেখে প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। হায় সহিংসতার ও মব ভায়োলেন্সের ভাইরাল সব ভিডিও দেখেও তিনি আগে যদি এমন কথা বলতেন!

সে যাক। হাদি হত্যাকাণ্ড ও তার প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে ফেরা যাক। শরিফ ওসমান হাদি হত্যার শিকার হয়েছেন, যিনি নির্বাচনে অংশ নিতে চেয়েছিলেন, জনসাধারণের প্রতিনিধিত্ব করতে চেয়েছিলেন, যিনি প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সামনে জেয়াফত করার মতো কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করেছিলেন। বলেছিলেন, বিরোধিতা করতে হলে আরেকটি প্রথম আলো তৈরি করতে।

হাদির মৃত্যুর খবরে হামলা চালানো হয় ছায়ানটে। ছবি: চরচা
হাদির মৃত্যুর খবরে হামলা চালানো হয় ছায়ানটে। ছবি: চরচা

কিন্তু দুঃখজনকভাবে হাদি আক্রান্ত হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন উঠল। এই প্রশ্ন তোলা হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা ছড়ানোর মাধ্যমে। আর তারপর তার মৃত্যু সম্পর্কে হৃদয়বিদারক তথ্যটি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টার সতর্কবার্তাকে সত্য রূপান্তরিত করে সংবাদমাধ্যমের দুটি কার্যালয় আক্রান্ত হলো ন্যাক্কারজনকভাবে, যা সুস্পষ্টভাবেই হাদির এ সম্পর্কিত অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এমনকি হাদির নেতৃত্বাধীন ইনকিলাব মঞ্চও এ হামলার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে। তাহলে কারা করল?

হাদি নির্বাচন করলে যাদের ভোটে ভাগ বসাতেন, বা যারা নির্বাচন না হলে কার্যত ক্ষমতা ভোগ করছে বলে সমাজে আলোচনা আছে, তিরটি কি তাদের দিকেই যায় না? নির্বাচন না হলে ক্ষমতাকেন্দ্র কোথায় থাকবে, কারা ক্ষমতা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভোগ করবে, নির্বাচন হলে কারা ক্ষমতা হারানোর শঙ্কায় ভোগে ইত্যাদি প্রশ্নকে আমলে নেওয়া তাই ভীষণভাবে জরুরি। পরাজিত শক্তি, ফ্যাসিস্ট শক্তি ইত্যাদি বলে দায়িত্ব না এড়িয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের মাধ্যমে হাদি হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা তাই দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার জন্যই ভীষণভাবে জরুরি। হাদির হত্যাকারীরা ধরা পড়ুক এবং একইসঙ্গে তার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে তাকে পুঁজি করে কেউ যেন কোনো দুরভিসন্ধিমূলক কিছু করতে না পারে, সে বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা নেবে–এটাই চাওয়া।

ফজলুল কবির: বার্তা সম্পাদক, চরচা

সম্পর্কিত