পর্ব–৩

রাশিয়ার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ব্রিটেন ও আমেরিকা কখনো দেয়নি

রাশিয়ার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ব্রিটেন ও আমেরিকা কখনো দেয়নি
ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

আমি ১৯৫৪ সালে জন্মগ্রহণ করেছি, তাই আমি পুরোপুরি স্নায়ুযুদ্ধের শিশু। আমি এর মধ্যেই বড় হয়েছি এবং স্নায়ুযুদ্ধের বিষয়ে অনেক কিছু জেনেছি। আমার স্ত্রী প্রাগে জন্মগ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ তিনি সোভিয়েত-নিয়ন্ত্রিত মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আমরা এ বিষয়ে সবকিছু জানি। ইউরি গ্যাগারিন তার কক্ষপথ থেকে ফিরে আসার পর যখন প্রাগে এসেছিলেন, তখন আমার স্ত্রী তার সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন।

এটিই ছিল আমার বেড়ে ওঠার পরিবেশ। আমেরিকান, ইউরোপীয় এবং ন্যাটোর ধারণা ছিল যে আমরা একটি অবিচল, আগ্রাসী, ধর্মবিরোধী, সর্বগ্রাসী কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক আন্দোলনের মুখোমুখি। আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিস্তার থেকে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে রক্ষা করছি। আমি বলব, সেই সময় আমেরিকান এবং ইউরোপীয়দের ৯৯.৯% মানুষই এই ধারণাটি পোষণ করত। আমি বার্লিনে দুবার চেকপয়েন্ট চার্লি পার হয়েছি এবং একজন তরুণ হিসেবে বহুবার বার্লিন প্রাচীর নিজের চোখে দেখেছি।

পুরো বিশ্বকে তখন বিভক্ত মনে হতো। অন্য পক্ষের শত্রুকেও অবিচল বলে মনে হতো। কিন্তু এখন যদি দেখি, কমিউনিজম নেই, সোভিয়েত ইউনিয়নও নেই, কিন্তু রাশিয়া সম্পর্কে এখনও সেই স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের মতোই বুলি আওড়ানো হয়। যেন কোনো পরিবর্তনই হয়নি।

কিন্তু আমার কথা হলো, সেই স্নায়ুযুদ্ধের ধারণাটি নিয়েও যদি আপনি বছরের পর বছর ধরে উভয় পক্ষে কাজ করেন, যেমনটা আমি মস্কোসহ বিশ্বের অনেক জায়গায় কাজ করেছি। বিশেষ করে ইউরোপের এই দুটি ভাগে। তখন দেখতে পাবেন যে পুরো যুদ্ধের বর্ণনাটি এক অর্থে একটি বিশাল ভুল ও ট্র্যাজেডি। কারণ এর আরেকটি গল্প আছে, যা আপনি ও আমি যে গল্পের মধ্যে বড় হয়েছি, তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

আর সেই গল্পটি হলো, সেই সময়কার সোভিয়েত এবং বর্তমানের রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য তাদের অনুসন্ধান। আমরা এই বিষয়টি নিয়ে এক মুহূর্তও ভাবি না। আমি বলতে পারি, আমার বেড়ে ওঠার সময় বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এক মিনিটের জন্যও এই বিষয়টি শুনিনি। আমার হার্ভার্ডে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ভালো শিক্ষা ছিল। কিন্তু আমি আমার ছাত্রজীবনে একদিনের জন্যও শুনিনি যে স্নায়ুযুদ্ধের গল্পের আরেকটি দিক ছিল।

হয়তো আমি ভুল ক্লাসে ছিলাম। কিন্তু আমি তখনকার পরিবেশের কথা বলছি, যা ছিল একটি অবিচল শত্রু। আমরা সলঝেনিৎসিনের লেখা পড়েছি। আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নের অপরাধ সম্পর্কে জানতাম। কিন্তু আমরা এক মুহূর্তের জন্যও থমকে ভাবিনি, নাৎসিদের হাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের ২ কোটি ৭০ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এর কী প্রভাব থাকতে পারে? তখন কী করা উচিত ছিল?

সেই সময় সোভিয়েত বা রাশিয়ার নিরাপত্তা সংক্রান্ত কী উদ্বেগ ছিল? তখন থেকে আমি প্রায় ৩০ বছর ধরে এই বিষয়গুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছি। আমি সত্যিই চাই মানুষ এই বিষয়টি বুঝুক: যখন আপনি ২ কোটি ৭০ লাখ মানুষের জীবন হারান, বা চীন, তাদের আজকের সামরিক বিজয় কুচকাওয়াজের কথা যদি বলি, তারাও জাপানের সঙ্গে যুদ্ধে কাছাকাছি সংখ্যক মানুষকে হারিয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, আমরা আমাদের তরুণ বয়সে এই বিষয়টি নিয়ে একদিনও আলোচনা করিনি। আমি জানতাম যে জাপান চীন আক্রমণ করেছিল। কিন্তু সেই যুদ্ধের বাস্তবতা বা ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা সম্পর্কে একটুও জানতাম না।

ইউরোপে ফিরে আসি, সোভিয়েত বা রুশরা বলেছিল, ‘তৃতীয়বারের মতো জার্মানির পুনর্সামরিকীকরণের বিরুদ্ধে আমরা নিজেদেরকে কীভাবে রক্ষা করব?’ কারণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আংশিকভাবে রাশিয়ার ওপর জার্মানদের যুদ্ধ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে হিটলারের আক্রমণ, যাতে ২ কোটি ৭০ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। আর সোভিয়েত পক্ষ বলেছিল, ‘আমাদের একটি শান্তি চুক্তি দরকার যা আমাদের নিরাপত্তার স্বার্থকে নিশ্চিত করবে।’ কিন্তু আমেরিকা ও ব্রিটেন তাতে ‘না’ বলেছিল। এমনকি ১৯৪৫ সালের বসন্তে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইসটন চার্চিল ‘অপারেশন আনথিঙ্কেবল’ নামে আমাদের যুদ্ধকালীন মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণের সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তা করছিলেন।

আপনার মিত্র সবেমাত্র ২ কোটি ৭০ লাখ মানুষকে হারিয়েছে, আর আপনি আপনার সেনাপতিকে জিজ্ঞাসা করছেন যে এই শরতে তাদের আক্রমণ করা উচিত কিনা! এটি সত্যিই অকল্পনীয়। কারণ রাশিয়ার প্রতি সেই অবিচল ঘৃণা অনেক পুরোনো। ব্রিটেনে এটি ১৮৪০-এর দশক থেকে চলে আসছে। এটিও আমাদের গল্পের একটি অংশ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে পোতসদাম-এ একটি মূল চুক্তি হয়েছিল একটি অসামরিকীকৃত, ঐক্যবদ্ধ জার্মানির জন্য। কিন্তু আমেরিকা তা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে। পরিবর্তে তারা বলেছিল, ‘আমরা আমাদের অংশটি, অর্থাৎ ব্রিটেন, আমেরিকা ও ফ্রান্সের দখল করা তিনটি অঞ্চল নেব। আমরা সেটিকে একটি নতুন ফেডারেল রিপাবলিক অফ জার্মানি বা পশ্চিম জার্মানি হিসেবে গড়ে তুলব। আমরা এর সামরিকীকরণ করব এবং ১৯৫৫ সালে এটিকে ন্যাটোতে, আমাদের নতুন সামরিক সংগঠনে, যুক্ত করব।’

১৯৪৫ সাল থেকে এই পুরো সময় জুড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন সঙ্গত কারণেই বলছিল, ‘কিন্তু আমাদের নিরাপত্তার কী হবে? আমরা কেবল ২ কোটি ৭০ লাখ মানুষের জীবন হারালাম।’ এটি কোনো দূরবর্তী ইতিহাস ছিল না। এটি ছিল একটি তাৎক্ষণিক বাস্তবতা, যেখানে আমেরিকা জার্মানির পুনর্মিলন করছিল। আপনি যদি বহু বছর আগের এই সিদ্ধান্তগুলোর দিকে ফিরে তাকান, তাহলে দেখবেন যে জর্জ কেনানের মতো অনেক মার্কিন কূটনীতিক বলেছিলেন, ‘চুক্তিটি মেনে নিন। একটি নিরপেক্ষ, অসামরিক জার্মানি স্নায়ুযুদ্ধ শেষ করবে।’

সোভিয়েত ইউনিয়নও বারবার এটি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিল। যেমন, ১৯৫৫ সালে অস্ট্রিয়ায় একটি চুক্তি হয়েছিল, যাতে বলা হয়েছিল, দেশটি নিরপেক্ষ থাকবে এবং ন্যাটোতে যোগ দেবে না। এর ফলে সোভিয়েত দখলদার বাহিনী পূর্ব অস্ট্রিয়া থেকে চলে গিয়েছিল এবং আর কখনো অস্ট্রিয়াকে বিরক্ত করেনি। তারা আমেরিকাকে এটাই বোঝাতে চেয়েছিল যে, জার্মানির ক্ষেত্রেও একই কাজ করলে স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আমেরিকা ও ব্রিটেনের মনোভাব ছিল “ব্লক মেন্টালিটি” বা জোটবদ্ধ মানসিকতা।

এই কারণেই গত ৩৫ বছরে যা ঘটেছে তা খুবই দুঃখজনক। কারণ ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে এবং ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভের মূল লক্ষ্য ছিল দুটি সামরিক জোটের অবসান ঘটিয়ে এই বিভাজনের সমাপ্তি ঘটানো। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি প্রথমে ওয়ারশ প্যাক্ট ভেঙে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমেরিকা ও ব্রিটেনের উন্মত্ত মানসিকতা ছিল যে, ‘এটি শান্তি নয়, আমরা জিতেছি। আমরা জিতেছি। এখন আমরা যা সবসময় চেয়েছি, তা করতে পারি।’

তাই আনুষ্ঠানিকভাবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ১৯৯০ সালে শেষ হয়েছিল, কারণ জার্মানির পুনর্মিলন না হওয়া পর্যন্ত আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ করার কোনো চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছিল। সেই পুনর্মিলনের সময়, আমেরিকা ও জার্মানি স্পষ্টভাবে বলেছিল যে ন্যাটো আর প্রসারিত হবে না। তাদের বলা উচিত ছিল যে, ন্যাটো শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তারা বলেছিল যে ন্যাটো পূর্বদিকে ‘এক ইঞ্চিও’ অগ্রসর হবে না। দুর্ভাগ্যবশত, গর্বাচভ এটি ‘৪+২’ চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করেননি। কারণ তিনি বলেছিলেন, এটি ন্যাটো নয়, জার্মানি নিয়ে একটি চুক্তি। তাই চুক্তিপত্রে এটি না থাকার একটি কারণ আছে।

কিন্তু প্রতিশ্রুতি ছিল যে ন্যাটো আর সম্প্রসারিত হবে না। আমেরিকান ও ব্রিটিশদের মানসিকতা ছিল এবং আমি ব্রিটিশদের কথা যোগ করছি। কারণ সামরিক দিক থেকে তাদের কোনো গুরুত্ব না থাকলেও মানসিক দিক থেকে তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বপ্ন দেখছিল। কিন্তু জার্মানি পুনরায় একত্রিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমেরিকা এক মুহূর্তও দেরি না করে বলল, ‘এখন ন্যাটো পূর্বদিকে যাবে। আমরা জিতেছি। আমরাই সামরিক জোট।’ তারা এক মুহূর্তের জন্যও রুশদের কথা শোনেনি। যারা বলছিল, ‘আমরা তো এখন আর যুদ্ধ করছি না। আমরা মাত্রই জোট ভেঙে দিলাম। তাহলে কেন আপনারা ন্যাটোকে ঠেলে দিচ্ছেন? ন্যাটো তো আর প্রসারিত হওয়ার কথা নয়।’

আর আমেরিকার মনোভাব ছিল, যেমনটা আপনি অবশ্যই জানেন, ‘তোমরা একটি তৃতীয় বা চতুর্থ-শ্রেণীর দেশ। তোমাদের কোনো মূল্য নেই। আমরা তোমাদের জন্য তেল পাম্প করে দিতে চাই। তাই আমরা শেভরন এবং এক্সনকে সেখানে চাই। এছাড়া তোমরা পারমাণবিক অস্ত্রসহ একটি ‘গ্যাস স্টেশন’। তোমাদের আমাদের কথা শুনতে হবে। তোমাদের কোনো বিকল্প নেই।’

১৯৯০-এর দশকে এই তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা ছিলেন জিগনিউ ব্রজেজিনস্কি। ব্যক্তিগতভাবে তিনি আমার কাছে একজন খুব ভালো মানুষ। কারণ আমি পোল্যান্ডকে পরামর্শ দিচ্ছিলাম। তিনি আমাকে আমার পরামর্শ বাস্তবায়নে সাহায্য করেছিলেন, যা কার্যকরও হয়েছিল। কিন্তু যখন রাশিয়ার কথা আসত, তিনি একজন সত্যিকারের পোলিশ দেশপ্রেমিক হয়ে উঠতেন। তিনি রাশিয়াকে ঘৃণা করতেন, যা সপ্তাদশ শতক থেকে চলে আসছে।

তিনি রাশিয়াকে ঘৃণা করতেন। তাই ১৯৯৭ সালে তিনি সবকিছু পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছিলেন: ‘ন্যাটো প্রসারিত করো, ইউরোপ প্রসারিত করো, রাশিয়ার আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। কারণ তারা কখনো চীনের সঙ্গে যোগ দিতে পারবে না।’ তার বইয়ে তিনি একটি পুরো অধ্যায় লিখেছেন, কেন রাশিয়া চীনের সঙ্গে জোট বাঁধবে না।

সুতরাং আমাদের এখনো মিথ্যা ও ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধ সম্পর্কে একটি সম্পূর্ণ একপেশে গল্প বলা হয়, যা ঐতিহাসিক দিক থেকে সম্পূর্ণ ভুল। ১৯৯১ সালের পর, আমাদের কাছে তথাকথিত ‘এককেন্দ্রীকতার’ মহত্ত্বের ধারণা আসে। আর এখন সেই এককেন্দ্রীকতা যেহেতু আর নেই এবং রাশিয়ার নিজস্ব নিরাপত্তার স্বার্থ রয়েছে, তাই আমরা সবচেয়ে আদিম ধরনের ‘রাশিয়া-ভীতির’ ফিরে আসা দেখছি। ইউরোপ দুই বা তিন দিন পর পর রাশিয়ার ভয়ে জড়োসড়ো হয় এবং টেবিলের চারপাশে বসা এই বোকারা রুশদের সঙ্গে কোনো কথাই বলে না। আর এই বোকাদের ধারনা আমেরিকা তাদের এই আগুন থেকে উদ্ধার করবে এবং রুশ ভালুকের হাত থেকে রক্ষা করবে।

চলবে...

সম্পর্কিত