বয়সটা যদি চল্লিশের ওপর হয়, তাহলে এমন স্মৃতি ভুলে যাওয়ার নয়। ঝিম মারা দুপুর। কিছুক্ষণ আগেই স্কুল থেকে হয়তো ফিরেছেন। মায়ের হাতে মাখানো ভাতও খাওয়া শেষ। রান্না ঘরের গোছগাছ শেষে মাও গিয়েছেন বিশ্রামে। এর মধ্যেই ঘরের রেডিওটা ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। সেখানে চলছে ‘বিজ্ঞাপন তরঙ্গ।’ ভারী কণ্ঠে একজন বলে চলেছেন.‘হ্যাঁ, ভাই ও বোনেরা। ‘ভেজা চোখ’ ছবিটি শুধু একটি কাহিনি চিত্র নয়। এক অমর প্রেমের আখ্যান। সম্রাট শাহজাহান যেভাবে ভালোবেসেছিল মমতাজমহলকে। সেভাবেই নিজের বুকের সব ভালোবাসা ইলিয়াস কাঞ্চন ঢেলে দিয়েছেন দিতিকে। দিতি কি সেই ভালোবাসার মর্যাদা দিতে পারবে?’ এভাবেই বর্ণনার মাধুর্য, আর সংগীতের মূর্ছনায় পুরো ছবির কাহিনিটিই যেন রেডিওর মাধ্যমে এক সময় উপভোগ করতেন সবাই। বাড়ির মা, বোন, মুরুব্বিরা।
কিংবা সেই কণ্ঠ কার কার মনে আছে? ‘আস্সালামু আলাইকুম! ঢাকা স্টেডিয়ামের সবুজ আঙিনা থেকে বলছি আমি আবদুল হামিদ। কিছুক্ষণের মধ্যেই সিনিয়র ডিভিশন ফুটবল লিগের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে মুখোমুখি হচ্ছ দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডান ও আবাহনী। কানায় কানায় পূর্ণ স্টেডিয়ামে দর্শকের গমগমে আওয়াজ নিশ্চয়ই শুনতে পাচ্ছেন প্রিয় দর্শক! ম্যাচটির চলতি ধারাবিবরণী প্রচারিত হচ্ছে রেডিও বাংলাদেশ ঢাকা কেন্দ্র থেকে…

এভাবেই লিগের শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচের রোমাঞ্চ খেলা প্রেমীরা উপভোগ করত রেডিওর মাধ্যমে। ইথারে ভেসে আসত প্রিয় তারকার নৈপুণ্যের বর্ণনা। উত্তেজনায় থর থর করে কাঁপতেন ফুটবলপ্রিয়রা। আপনি খেলাটা চোখে দেখছেন না, কিন্তু ঠিকই ধারাভাষ্যকারদের বর্ণনার মাধুর্যে আপনার সামনে উজ্জল হয়ে উঠছে ম্যাচের প্রতিটি মুহূর্তের দৃশ্যপট।
রেডিওর যুগের সেই স্মৃতি মন থেকে সহজে মুছে ফেলার নয়। রেডিও শুধুমাত্র একটি যন্ত্র ছিল না।
সে ছিল প্রেমিক, যে খবর দিত দিনের… আর ঘুম পাড়াত গান শুনিয়ে রাতের।
সে ছিল অভিভাবক, যে শেখাত—জীবন, দেশ, সভ্যতা। সে আনন্দ দিত, রোমাঞ্চিত করত। সে মানুষকে
একটা গোটা প্রজন্মের প্রথম ভালোবাসা ছিল এই রেডিও।
দেশের রাজনীতির উত্তাল দিনগুলোতে রেডিও যে কী দুর্দান্ত ভূমিকা পালন করেছে, সেটা একটা প্রজন্ম খুব ভালো করেই জানে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযোদ্ধায় রেডিওতেই এই দেশের মানুষ শুনেছিল স্বাধীনতার ঘোষণা, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের গানগুলো উদ্দীপনা জোগাত দেশের অবরুদ্ধ মানুষদের। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রেরই বিশেষ সেই অনুষ্ঠান—চরমপত্র বন্দী জীবনে ছিল অনুপ্রেরণা আর রোমাঞ্চের উৎস। একটা সময় বিবিসি কিংবা ভয়েস অব আমেরিকা যে বিদেশি রেডিও স্টেশন, সেটাই তো মানুষ ভুলে গিয়েছিল। সামরিক শাসনের দিনগুলোতে এই বিবিসি কিংবা ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদ ছিল তথ্য বঞ্চিত সাধারণ মানুষের আসল খবর জানার উৎস। ১৯৯০-এর অভ্যুত্থানের সময়টা মনে আছে? মানুষ ঘড়ির কাটায় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা কখন বাজবে, তার জন্য অপেক্ষা করত। তখনই যে শুরু হতো বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠান। রাত দশটায় ভয়েস অব আমেরিকার সেই সিগনেচার টিউন এখনো বাংলাদেশের অনেক মানুষের নস্টালজিয়া।
খেলার চলতি ধারা বিবরণীর কথা আগেই বলা হয়েছে। এই প্রজন্মের তো সেই অভিজ্ঞতা নেই। শ্বাসরুদ্ধকর ফুটবল লিগের ম্যাচের ধারাভাষ্য রেডিওর সামনে বসে শোনাতে স্নায়ুর ওপর কতটা চাপ পড়ত, সেটা তারা জানে না। রেডিওর সামনে বসে প্রিয় দলের খেলা শোনার সময় স্টেডিয়ামের দর্শকদের সেই গমগমে আওয়াজ উত্তেজনার ঢেউ তুলত। বিদেশের খেলার খবর পাওয়া কোনো ব্যাপারই না এখন। এক সময় ক্রিকেট-রোমান্টিকরা রেডিওতে কান পাততেন ক্রিকেট কিংবদন্তিদের খেলার বিবরণী শোনার জন্য। বিবিসির ‘টেস্ট ম্যাচ স্পেশাল’, রেডিও অস্ট্রেলিয়া, রেডিও পাকিস্তান কিংবা ভারতের আকাশবাণী—সবই কয়েকটি প্রজন্মের স্মৃতিতে মিশে আছে। সেই প্রজন্মের অনেকে হয়তো দুনিয়াতেই নেই।
বাংলাদেশে রেডিওর যাত্রা শুরু হয় ১৯৩৯ সালে, ব্রিটিশ ভারতের কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে।
ঢাকায় পূর্ণাঙ্গ বেতার কেন্দ্র চালু হয় ১৯৬০ সালে। স্বাধীনতার পর দেশের জাতীয় বেতার কেন্দ্রের নাম ছিল বাংলাদেশ বেতার। পরবর্তীতে এটির নামকরণ করা হয় রেডিও বাংলাদেশ। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে আবারও ‘বাংলাদেশ বেতার’ নামটি ফেরানো হয়। বাংলাদেশ বেতার বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার অনুষঙ্গ হয়ে প্রতিকূল যুগে এখনও টিকে আছে। বাংলাদেশ বেতারে এক সময় নাটকে কণ্ঠ দিতেন, দেশের বরেণ্য অভিনেতা, অভিনেত্রীরা। বাংলাদেশ বেতারে গানে কণ্ঠ দেওয়াকে শিল্পীরা অনেক বড় সম্মান হিসেবে দেখতেন। বেতারে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ‘কথিকা’ প্রচারিত হতো, এ যুগে অডিও-ভিডিও পডকাস্টের ধারণা এই ‘কথিকা’ থেকেই এসেছে। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশি সংস্কৃতির বহু স্বর্ন সময়ের সাক্ষী বাংলাদেশ বেতার।
বাংলাদেশে রেডিওর স্বর্ণযুগ নিঃসন্দেহে সত্তর আশি ও নব্বইয়ের দশক। এমনকি এক গবেষণায় দেখা গেছে ১৯৯০ সালে দেশের সত্তর শতাংশ জনগোষ্ঠী কোনো না কোনোভাবে রেডিও শুনতেন। সে কারণে দেশের যেকোনো ক্রান্তিকালে রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানেরা জাতির উদ্দেশ্যে রেডিওতে ভাষণ দিতেন। পরে টেলিভিশনের রমরমা শুরু হলে সরকার প্রধানের বক্তৃতা রেডিও ও টেলিভিশনের একযোগে প্রচারিত হতো।
রেডিও নিঃসন্দেহে একটা সময় পর্যন্ত ছিল দেশ-বিদেশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এন্টারটেইনমেন্ট ও ইনফরমেশন ডিভাইস। কিন্তু নতুন, নতুন প্রযুক্তির উদ্ভব ধীরে ধীরে রেডিওকে পেছনের কাতারে ঠেলে দেয়। টেলিভিশন রেডিওর আধিপত্যকে প্রবলভাবে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। তবে প্রযুক্তি এমন একটা জিনিস যেটি পুরোনোকে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করে। টেলিভিশনের সঙ্গে প্রবল প্রতিযোগিতায় একটা সময় রেডিও পিছু হটে। মানুষের বিনোদন দুনিয়ার প্রায় পুরোটাই দখলে চলে যায় টেলিভিশনের। যে খেলা টেলিভিশনের সরাসরি দেখা যায়, সেটির চলতি ধারা বিবরণী লোকে কেন রেডিওতে কান পেতে শুনবে! একই ব্যাপার প্রযোজ্য, নাটক, বিজ্ঞাপন বা যেকোনো আলেখ্যা অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে। টেলিভিশনের প্রতাপে রেডিওর বাণিজ্যিক প্রাপ্তিও কমতে থাকে। টেলিভিশনেই বিজ্ঞাপনের জন্য খরচে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন সবাই। রেডিও কেন্দ্রগুলোর আয়ও ভীষণভাবে কমতে থাকে।
প্রযুক্তির জোয়ারে এসেছে ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন। একুশ শতকের শুরুর দশকেই মোবাইলে ইন্টারনেট ব্রাউজিং মানুষের জীবনধারা বদলে দেয়। স্মার্টফোন হয়ে ওঠে পকেটের মধ্যেই একেকটি কম্পিউটার ডিভাইস। এসেছে সোশ্যাল মিডিয়া, ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ আর কত কি! পকেটের স্মার্টফোনই এখন বিনোদনের উৎস। মজার ব্যাপার রেডিও শুনতে এখন আর রেডিও সেট কেনা লাগে না, পকেটের স্মার্টফোনের অ্যাপেই সেটা শোনা যায়।
তবে নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগে এফএম স্টেশনগুলো রেডিওর দিকে মানুষের আকর্ষণ আবারও ঘুরিয়েছিল। বিষয়বস্তুর সমাহার, অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে তরুণদের টার্গেট করে এফএমের মাধ্যমে রেডিও ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। সারা দুনিয়াতে অসংখ্য এফএম রেডিও গড়ে ওঠে প্রযুক্তিগত সুবিধার কারণে এতে বিনিয়োগ একটা পুর্নাঙ্গ রেডিও স্টেশনের চেয়ে কম ছিল বলে। তা ছাড়া এফএম রেডিও স্টেশনগুলো মিউজিক রিলেটেড অনুষ্ঠানকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে তরুণ ও সংগীতপ্রিয়দের মধ্যে এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশে এই শতকের শুরুর দিকে রেডিও ফূর্তি, রেডিও টুডে ও এবিসি রেডিও, রেডিও স্বাধীন ইত্যাদি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এসব এফএম স্টেশন খবর, বিনোদনে সবার মনোযোগের কেন্দ্রে চলে আসে। তবে এই রেডিও স্টেশনগুলোর সাফল্যে ব্যাঙের ছাতার মতো এফএম স্টেশন গড়ে উঠতে থাকে। ফলে যা হবার তা-ই হয়েছে, এফএমও মুখ থুবড়ে পড়েছে। যদিও যুগের বাস্তবতায় সারা দুনিয়াতেই রেডিও মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিবিসি কিছু দিন আগেই তার রেডিও সার্ভিস বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ হয়ে গেছে বাংলা সার্ভিস। দুনিয়ার প্রায় সব প্রধান রেডিও স্টেশনগুলোই তাঁর আঞ্চলিক ও ভিন্ন ভাষার সার্ভিস বন্ধ করে দেওয়া শুরু করেছে।
এর পরেও রেডিও ‘শেষ’ হয়ে গেছে—এটা কি বলা যায়? রেডিও তার রূপ বদলেছে, হারিয়ে যায়নি। আগেই বলা হয়েছে
আজকের পডকাস্ট, ভয়েস স্ট্রিমিং, অনলাইন রেডিও — সবই তো রেডিও অনুষ্ঠানের ধারণা থেকেই আসা।
রেডিও এখনো কাজে লাগে দুর্যোগকালে জরুরি বার্তা পৌঁছাতে।
গ্রামীণ এলাকায় কৃষি ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য ছড়াতে।
এবং… আবেগঘন কিছু মুহূর্তে পুরোনো গানের সঙ্গে ফেলে আসা দিনগুলো খুঁজে পেতে।