গ্যাসের উৎপাদন কমেছে ৩৭%, সংকট মেটাতে আমদানিই ভরসা

গ্যাসের উৎপাদন কমেছে ৩৭%, সংকট মেটাতে আমদানিই ভরসা
বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র। রয়টার্স ফাইল ফটো

দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানার মজুত ফুরিয়ে আসছে। এক হিসাবে দেখা গেছে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন কমেছে প্রায় ৩৭ শতাংশ। একই হারে সার্বিক গ্যাস উৎপাদনও কমেছে। এ অবস্থায় গ্যাসের সংকট মেটাতে আমদানির ওপরই ভরসা রাখা হচ্ছে।

বাড়তে থাকা চাহিদার বিপরীতে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। বরং বর্তমান উৎপাদন অব্যাহত রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক সময় দেশীয় উৎস থেকে প্রায় ২৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া গেলেও গত ২০ ডিসেম্বর পাওয়া গেছে মাত্র ১৭৪৮ মিলিয়ন। অর্থাৎ, গ্যাসের উৎপাদন কমেছে মোটের ওপর ৩৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

এদিকে দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানার মজুতও ফুরিয়ে আসছে। দেশীয় উৎপাদনের ৫০ শতাংশের বেশি যোগান দেওয়া বিবিয়ানা এক সময় গড়ে ১৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করত। ২০ ডিসেম্বর বিবিয়ানা সরবরাহ করেছে মাত্র ৮৫৫ মিলিয়ন ঘনফুট, যা গড় সরবরাহের তুলনায় ৩৬ শতাংশ কম।

খোদ পেট্রোবাংলার অনেকেই মনে করেন, বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডে হঠাৎ করেই বড় ধরনের ধস দেখা দিতে পারে। ২০২৬ সালের শেষ দিকে বিবিয়ানার উৎপাদন ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের নিচে নেমে আসতে পারে। এ শঙ্কা সত্যি হলে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন দেড় হাজার মিলিয়নের নিচে নেমে যাবে।

এ বিষয়ে ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরুল ইমাম চরচাকে বলেন, “এমনিতেই বিবিয়ানার উৎপাদন কমছে। যেকোনো সময় উৎপাদনে বড় ধরনের বিপর্যয় হতে পারে।

সব মিলিয়ে গ্যাস সংকট সামাল দিতে এলএনজি আমদানি বাড়ানোর পথেই হাঁটছে পেট্রোবাংলা। মহেশখালী-বাখরাবাদ ‍তৃতীয় সমান্তরাল গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ করতে যাচ্ছে সরকার।

দেশে গ্যাসের ঘাটতি সামাল দিতে দুটি ফ্লোটিং গ্যাস রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) দিয়ে বর্তমানে ১১০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাস আমদানি করা হচ্ছে। তবে বিদ্যমান পাইপলাইন দিয়ে দৈনিক সর্বোচ্চ ১৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানি সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে দেশীয় উৎস ও আমদানি করা এলএনজি দিয়েও মিটছে না গ্যাসের চাহিদা।

এ ঘাটতি সামাল দিতে এলএনজি আমদানি বাড়ানোর পথেই হাঁটছে পেট্রোবাংলা। তৃতীয় এফএসআরইউ (৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট) এবং ল্যান্ডবেজড এলএনজি টার্মিনাল (১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট সক্ষমতা) স্থাপনের আলোচনা চলমান। প্রস্তাবিত দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে দৈনিক এলএনজি আমদানির সক্ষমতা দাঁড়াবে ২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুটে। এরই মধ্যে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল (এফএসআরইউ) নির্মাণের দরপত্র প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে সময় বাঁচাতে প্রকল্পটি জি-টু-জি ভিত্তিতে করার কথা বিবেচনা করছে পেট্রোবাংলা।

এফএসআরইউ হলেও গ্যাস সরাসরি ঢাকায় আনার কোনো ‍সুযোগ নেই। সে কারণে পাইপলাইনের সক্ষমতা বাড়াতে মহেশখালী-বাখরাবাদ ‍তৃতীয় সমান্তরাল গ্যাস পাইপলাইনের ‍প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। একটি বহুজাতিক কোম্পানি প্রাক-সমীক্ষা করেছে। এতে মহেশখালী (সিটিএমএস) থেকে বাখরাবাদ পর্যন্ত ৩২৬ কিলোমিটার ৪৬ ইঞ্চি ব্যাসের এবং মাতারবাড়ি থেকে উত্তর নলবিলা ভাল্ব স্টেশন (মহেশখালী) পর্যন্ত ৯ কিলোমিটার ৪০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২৪ হাজার ৩২০ কোটি টাকা।

প্রাক-উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) অনুযায়ী, প্রকল্পটির কাজ শেষ হতে পাঁচ বছর সময় লাগবে। এদিকে প্রকল্পটিতে অর্থায়নের সক্ষমতা নেই বলে জানিয়ে দিয়েছে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানির (জিটিসিএল)। এ কারণে প্রকল্প প্রস্তাবে বিদেশি অর্থায়নের কথা বলা হয়েছে। ওই পাইপলাইনের ওপর নির্ভর করছে গ্যাস আমদানি বৃদ্ধির বিষয়টি।

বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান গত ২১ অক্টোবর এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, “দেশে প্রাথমিক জ্বালানির ঘাটতি রয়েছে। প্রতিনিয়ত দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমছে। বছরে গড়ে দৈনিক উৎপাদন ২০০ মিলিয়ন (ঘনফুট) কমছে। আমরা অনেক চেষ্টা করেও উৎপাদন ধরে রাখতে পারছি না। ঘাটতি মেটাতে এলএনজি আমদানি করছি, যা খুবই ব্যয়বহুল। পাশাপাশি এলএনজি আমদানির অবকাঠামো (তৈরির) চ্যালেঞ্জ রয়েছে।”

যদিও এলএনজি আমদানির চেয়ে দেশীয় উৎসে মনযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, “গ্যাসের জন্য বিবিয়ানা ও এর আশপাশের এলাকা বেশ সম্ভাবনাময় বলে ধরে নেওয়া যায়। কাজেই ওখানে আরও বেশি কূপ খনন করে দেখা যেতে পারে। এলএনজি আমদানি করে গ্যাসের চাহিদা মেটানো বাংলাদেশের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং। দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেওয়াটা অধিক টেকসই।”

সম্পর্কিত