হাদির ওপর হামলা: মোটরসাইকেল নম্বর শনাক্তে ভুল, যেভাবে রিমান্ডে হান্নান

সামদানী হক নাজুম, ঢাকা
সামদানী হক নাজুম, ঢাকা
হাদির ওপর হামলা: মোটরসাইকেল নম্বর শনাক্তে ভুল, যেভাবে রিমান্ডে হান্নান
হামলায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল শনাক্তে ভুল হওয়ায় গ্রেপ্তার হন আব্দুল হান্নান। ছবি: চরচা

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি সিসিটিভি ফুটেজ দেখে শনাক্ত করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শনাক্ত করা সেই মোটরসাইকেলের মালিক আব্দুল হান্নানকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার কাছ থেকে তথ্য উদ্ধারের জন্য ৩ দিনের রিমান্ডও মঞ্জুর করেন আদালত। এখন দেখা যাচ্ছে হামলায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের নম্বর শনাক্তে ভুল করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শুধু নম্বর নয়, মোটরসাইকেলের মডেলও ওলটপালট হয়েছে।

আগামীকাল বুধবার হান্নানের রিমান্ড শেষ হওয়ার কথা। তবে এরই মধ্যে সামনে এসেছে এই গরমিল। মূলত হত্যাচেষ্টার অপরাধে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটির সঙ্গে হান্নানের মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন নম্বরের শেষ ডিজিটে গরমিল হয়।

হান্নানের মোটরসাইকেলের নম্বর হলো: ঢাকা মেট্রো ল ৫৪-৬৩৭৫, কিন্তু অপরাধে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের নম্বর ঢাকা মেট্রো ল ৫৪-৬৩৭৬। নম্বরের শেষে ৬-এর জায়গায় ৫ শনাক্তে এমন গরমিল হলো তদন্তে।

গত ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর বিজয়নগর কালভার্ট রোডে হাদির ওপর হামলার সঙ্গে সঙ্গে আাশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়। হামলাকারী দুজনকে শনাক্তে কাজ শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

ফুটেজে প্রথমেই শনাক্ত হয় হোন্ডা হর্নেট সিরিজের মেটরসাইকেলটি। এর নম্বর বলা হয় ঢাকা মেট্রো ল ৫৪-৬৩৭৫। এই নম্বরের সূত্রে বিআরটিএ-এর সার্ভার থেকে মালিকের তথ্য নিয়ে রাজধানীর মোহম্মদপুর এলাকা থেকে গত শনিবার রাতে বাহনটির মালিক আব্দুল হান্নানকে আটক করে র‍্যাব।

পরদিন হান্নানকে পল্টন থানায় হস্তান্তর করা হলে একটি জিডির ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। প্রথমে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে হান্নানকে আদালতে হাজির করা হয়। পরে তাকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন জিডির তদন্তকারী কর্মকর্তা পল্টন থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক শামীম হাসান।

পরে অন্য একটি আবেদনে হান্নানের ৭ দিনের রিমান্ড চাওয়া হলে ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। আদালতে হান্নানের পক্ষে কোনো আইনজীবীও ছিলেন না। এজলাস থেকে ম্যাজিস্ট্রেটের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে হান্নানকে কথা বলার সুযোগ দেন তিনি।

সে সময় আব্দুল হান্নান বলেন, “আমি এই মোটরসাইকেলটি মিরপুর মাজার রোড থেকে কিনেছি। পরে অসুস্থ ছিলাম বলে সবাই আমাকে মোটরসাইকেল চালাতে নিষেধ করে। এ কারণে আমি মোটরসাইকেল চালানো বন্ধ রাখি। এরপর থেকে বাইকটি বাসায় পড়ে ছিল। পরে মোটরসাইকেলটি একটি শোরুমে বিক্রি করি। তাদের আমি পরে নাম চেঞ্জ করে দেব বলে জানাই। দুই মাস পর নাম চেঞ্জ করে দেওয়ার কথা ছিল। শোরুম থেকে আমাকে নাম চেঞ্জের জন্য ডাকা হলেও অসুস্থতার জন্য যেতে পারিনি।”

আব্দুল হান্নান আদালতে আরও বলেন, “আমাকে গ্রেপ্তারের সময় পুলিশকে বলেছি, ভালো করে তদন্ত করেন। প্রয়োজনে ওই শোরুমে আমাকে নিয়ে যান, তাহলে সব সত্যি বের হবে। কিন্তু তারা আমাকে সেখানে নিয়ে যায়নি বরং মামলা দিয়ে থানায় আটকে রাখে। আমি নির্দোষ। এ ঘটনায় কিছুই জানি না।”

পরদিন হান্নানের কথার সত্যতা যাচাই করতে গেলে বড় ধরনের গরমিল সামনে আসে। চরচার হাতে আসে ঢাকা মেট্রো ল ৫৪-৬৩৭৫ নম্বরের মোটরসাইকেলটির বিআরটিএ-এর রেজিস্ট্রেশন তথ্য।

সেখানে মালিকের নাম আব্দুল হান্নান আছে ঠিকই, তবে ভিন্নতা চোখে পড়ে মোটরসাইকেলের নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এবং মডেলে। হামলায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি ছিল হোন্ডা কোম্পানির হর্নেট সিরিজের। আর বিআরটিএর রেজিস্ট্রেশন তথ্য বলছে, ঢাকা মেট্রো ল ৫৪-৬৩৭৫ নম্বরের মেটরসাইকেলটি হলো সুজুকি জিক্সার। একই তথ্য পান তদন্তকারী কর্মকর্তা। তখন ধারণা করা হয়, হামলাকারীরা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী হান্নানের মোটরসাইকেলের নম্বর ব্যবহার করে ভুয়া নম্বর প্লেট তৈরি করে সেটি ব্যবহার করেছিল।

এদিকে হান্নান যে শোরুমে তার বাইক বিক্রির কথা জানিয়েছেন, সেখানে খোঁজ নেয় চরচা। মিরপুরে অবস্থিত ‘রেসার’ নামক শোরুমের স্বত্ত্বাধীকারী আতাউল্লাহ সোহাগ চরচাকে জানান, আব্দুল হান্নান চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে তাদের শোরুমে একটি মোটরসাইকেল বিক্রি করেন। তবে সেটি সুজুকি জিক্সার নয়, এমনকি ঢাকা মেট্রো ল ৫৪-৬৩৭৫ নম্বরেরও নয়।

তিনি বিক্রি করেন ইয়ামাহা এফজেডএস মডেলের মোটরসাইকেল, যার নম্বর ঢাকা মেট্রো ল- ৬৫-৩৫৮৪। এই মোটরসাইকেল বিক্রয়-সংক্রান্ত সকল নথি চরচাকে সরবারহ করেন আতাউল্লাহ সোহাগ।

বিআরটিএর তথ্য বলছে এই মোটরসাইকেলের মালিকও আব্দুল হান্নান। এমন বিভ্রান্তির পর তদন্তকারী কর্মকর্তা শোরুম মালিক আতাউল্লাহ সোহাগকে হান্নানের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার সুযোগ দেন। তখন জানা যায়, ঢাকা মেট্রো ল ৫৪-৬৩৭৫ নম্বরের সুজুকি জিক্সার মোটরসাইকেলটি হান্নান মোহম্মদপুরের আরেক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেন ২০২৪ সালের জুন মাসে।

ওই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এই তথ্যের সত্যতা মেলে। দুই মোটরসাইকেল ব্যবহারের পর বিক্রি করা হলেও সেগুলোর মালিকানা পরিবর্তন করে দেননি হান্নান। ফলে জিক্সার এবং এফজেডএস মোটরসাইকেল দুটি হান্নানের নামেই রয়ে যায়।

হোন্ডা হর্নেট জব্দ

হাদির ওপর হামলার পর সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে হোন্ডা হর্নেট সিরিজের মোটরসাইকেলটিকে শনাক্ত করে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এর নম্বর নোট করা হয় ঢাকা মেট্রো ল ৫৪-৬৩৭৫, যেখানে এর নম্বর মূলত ছিল ঢাকা মেট্রো ল ৫৪-৬৩৭৬।

এরই ধারাবাহিকতায় হান্নানকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। তবে ঘটনার সময়ের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ এবং প্রযুক্তির ব্যবহার করে দুই অপরাধীর পালিয়ে যাওয়ার রোড ম্যাপ তৈরি করে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

এরই ধারাবাহিকতায় নিশ্চিত হওয়া যায়, শুক্রবার দুপুর ২টা ২১ মিনিটে বিজয়নগর কালভার্ট রোডে হাদির ওপর হামলা চালিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে পলাশি-নিউমার্কেট এলাকা দিয়ে রাজধানীর আগারগাঁও চলে যান শ্যুটার ফয়সাল ও চালক আলমগীর।

আগারগাঁওয়ে বিএনপি বাজারে ফয়সালের বোনের বাসার নিচে গ্যারেজে মোটরসাইকেলটি তারা রেখে যান। এরপর মোটরসাইকেলে যুক্ত ঢাকা মেট্রো ল ৫৪-৬৩৭৬ নম্বর প্লেটটি খুলে বাসার পাশের ম্যানহোলে ফেলে দেন। সেখান থেকে আদাবর চলে যান তারা। এই পুরো কার্যক্রমের ফুটেজ ধরা পড়ে ফয়সালের বোনের বাসা এবং এর আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে।

ইতোমধ্যে হামলায় ব্যবহৃত হোন্ডা হর্নেট মোটরসাইকেল এবং ম্যানহোল থেকে এর নম্বর প্লেট উদ্ধার করা হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে নিশ্চিত হয়েছে চরচা। সেই নম্বরের সূত্র ধরে মোটরসাইকেলটির মালিকানা যাচাইয়ের প্রক্রিয়া এখন চলমান।

যে জিডির ভিত্তিতে ঘটনার সঙ্গে হান্নানের সম্পৃক্ততার তদন্ত চলছিল, তার তদন্তকারী কর্মকর্তার তদন্তেও উঠে এসেছে যে, হান্নান নিরপরাধ। তদন্তকারী কর্মকর্তা পল্টন থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক শামীম হাসান চরচাকে বলেন, “আমরা তার কোনো সম্পৃক্ততা পাইনি। বুধবার আদালতে এ মর্মে প্রতিবেদন দাখিল করব।”

হান্নানকে যারা গ্রেপ্তার করেছে, সেই র‍্যাবের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুঃখ প্রকাশ করে চরচাকে জানান, প্রথমেই যখন ঢাকা মেট্রো ল ৫৪-৬৩৭৫ এই নম্বরটি জানা যায়, তখনই র‍্যাবসহ সকল বাহিনী এটি ধরেই কাজ শুরু করে। নম্বর প্লেটের স্পষ্ট ছবি না থাকায় এবং ৫-৬ সংখ্যা দুটি কাছাকাছি হওয়ায় এমন বিভ্রান্তি হয়েছে। অনেক আলোচিত ঘটনা হওয়ায় তদন্তে তাড়াহুড়ো করতে গিয়েই এমন ভুল হয়েছে।

পারিপার্শ্বিক চাপকে পাশে রেখে তদন্ত এবং ছায়া তদন্তে সম্পৃক্তদের সবকিছু আরও ভালোভাবে যাচাই করা প্রয়োজন ছিল বলে মত দেন তিনি।

সম্পর্কিত