আবার চাঙা অস্ত্রের কালোবাজার, বাড়ছে হামলা-গোলাগুলি

সামদানী হক নাজুম, ঢাকা
সামদানী হক নাজুম, ঢাকা
আবার চাঙা অস্ত্রের কালোবাজার, বাড়ছে হামলা-গোলাগুলি
নরসিংদী থেকে উদ্ধার এসব আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি উদ্ধার ওসমান হাদির ওপর হামলায় ব্যবহার করা হয়েছে বলে র‍্যাব জানিয়েছে। ছবি: র‍্যাবের সৌজন্যে

ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদির ওপর হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, তাকে গুলি করতে ব্যবহার করা হয় পয়েন্ট ৩২ বোরের ৭.৬৫ মিলিমিটার (এমএম) বুলেট।

পরে দুটি বিদেশি অস্ত্র উদ্ধার করে র‌্যাব। সংস্থাটি বলেছে, ওসমান হাদিকে গুলি করায় এর একটি ব্যবহার করা হয়। উদ্ধার হওয়া অস্ত্র দুটিই ৭.৬৫ এমএম বুলেট ব্যবহারযোগ্য, যেগুলোর কোনো আইডি নম্বর ছিল না। প্রশ্ন হলো–এসব অস্ত্র হামলাকারীরা পেল কীভাবে?

এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে দেখা যাক, গত ১২ ডিসেম্বর কী ঘটেছিল। ওই দিন রাজধানীর বিজয়নগরের কালভার্ট রোডে গুলি করা হয় ওসমান হাদিকে। এই ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা জানতে পারেন তাকে গুলি করা ফয়সাল করিম মাসুদ ঘটনার পর সর্বশেষ যোগাযোগ করেন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি এলাকার অবৈধ অস্ত্রের কারবারিদের সঙ্গে। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা এবং সীমান্তবর্তী হওয়ার কারণে ফটিকছড়িতে অবৈধ অস্ত্রের আনাগোনা সবসময়ই বেশি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে বহু অস্ত্র ও গুলি উদ্ধারও করেছে সেখান থেকে।

হাদির ওপর হামলার সঙ্গে ফটিকছড়ির যোগাযোগ পাওয়ার পর থেকে অনেকেই মনে করছেন, নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রকরা।

গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক হয়। থানা থেকে লুট হয় অস্ত্র। ফলে পরিস্থিতি চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় বসার পর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও নির্বাচন ঘিরে নতুন করে শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি বলছে, আবারও চাঙা হয়েছে অস্ত্রের কালোবাজার।

এদিকে অপরাধ কর্মকাণ্ডের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা গ্রুপগুলোর শক্তির ভিত্তি তাদের নেটওয়ার্ক এবং মজুত থাকা অবৈধ অস্ত্র। এসব অস্ত্র বিভিন্ন উৎস থেকে অবৈধভাবে সংগ্রহ করে সন্ত্রাসী গ্রুপ এবং অপরাধীরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর তথ্য বলছে, সীমান্তে চোরাচালান, অস্ত্রের বৈধ ব্যবসায়ীদের অবৈধ কারবার, দেশীয় অস্ত্রের অবৈধ কারখানা থেকে নিয়মিত অস্ত্রের যোগান পায় অপরাধীরা। এর বাইরে দেশের শ্যুটিং ক্লাবগুলোর অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে খোলা বাজার বা ব্যক্তির হাতে চলে যাচ্ছে বুলেট।

৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর দেশের বিভিন্ন থানার লুট হওয়া পুলিশের অস্ত্রের একটি অংশের কোনো হদিস নেই। পুলিশের এই বৈধ অস্ত্রগুলোও অপরাধীদের অস্ত্রের যোগান নিশ্চিত করছে।

৫ আগস্টের পর দেশের বিভিন্ন থানা ও পুলিশফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া অস্ত্রের সব এখনো উদ্ধার হয়নি। ছবি: সংগৃহীত
৫ আগস্টের পর দেশের বিভিন্ন থানা ও পুলিশফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া অস্ত্রের সব এখনো উদ্ধার হয়নি। ছবি: সংগৃহীত

দেশীয় অস্ত্রের কারখানা

দেশের অবৈধ অস্ত্রের বড় উৎস হলো হাতে তৈরি অস্ত্র। কাটা রাইফেল, পাইপ গানের মতো অস্ত্রগুলো স্থানীয়ভাবেই তৈরি করে অবৈধ অস্ত্র কারবারিরা। দেশীয়ভাবে তৈরি অস্ত্রের দাম কম ও সহজলভ্য হওয়ায় রাজধানীসহ সারা দেশের অপরাধ জগতে বেশ জনপ্রিয়। উঠতি বয়সী অপরাধীরাও সহজে এসব দেশীয় অস্ত্র হাতের কাছে পেয়ে যায়। কক্সবাজারের মহেশখালী, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অস্ত্রের কারখানার খোঁজ মিলেছে সময়ে সময়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযান চললেও কখনোই বন্ধ করা যায়নি এসব দেশীয় অস্ত্রের কারখানা।

এসব কারখানা একেবারে বন্ধ করতে না পারার পেছনে একাধিক চ্যালেঞ্জের কথা জানান র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী।

চরচাকে ইন্তেখাব চৌধুরী বলেন, “প্রথমত লোকালয়ের মাঝে এই কারখানাগুলো হয়। ফলে বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালানো খুবই কঠিন কাজ। দ্বিতীয়ত, এই কারখানা যারা পরিচালনা করে, তাদের নেটওয়ার্ক খুবই তৎপর। আমরা গোয়েন্দা তথ্য নিয়ে অভিযানে যাওয়ার সময় তারা খবর পেয়ে সরে যায়। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো চাহিদা। এই অস্ত্রের চাহিদা আছে বলেই কোনো না কোনোভাবে এই কারখানাগুলো চলছে।”

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, “সকল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়মিত এসব কারখানার বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। তারপরও আবার কিছুদিন পর অন্য কোথাও আরেকটি কারখানা চালু করে অপরাধীরা।”

সীমান্তে চোরাচালান

বাংলাদেশের সীমানা ভারত ও মিয়ানমার দ্বারা বেষ্টিত। মাদক, জাল টাকা কিংবা অন্যান্য পণ্যের মতো অস্ত্রের চোরাচালান হয় প্রতিবেশী এই দুই দেশ থেকেও। ভারতীয় কাঠের বাটের পিস্তল বাংলাদেশের অপরাধ জগতে জনপ্রিয়। যশোরের বেনাপোল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ব্রাহ্মণবড়িয়ার আখাউড়াসহ ভারতীয় সকল সীমান্ত এলাকা দিয়েই নিয়মিত এসব অস্ত্রের চালান আসে বাংলাদেশে। শুধু যে ভারতে তৈরি অস্ত্রের চালান আসে, তা নয়। আসে উন্নত দেশগুলোর তৈরি আধুনিক অস্ত্রও। সীমান্ত হাটগুলোতে নানা পণ্যের আড়ালে নিয়মিতই হাত বদল হয় অবৈধ অস্ত্র। কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁকে হাত বাড়িয়েই পাশের দেশগুলো থেকে অবৈধ অস্ত্র দেশে নিয়ে আসছে চোরাকারবারিরা।

সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির পরিসংখ্যান বলছে, দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় অভিযান চালিয়ে গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত গত তিন মাসে ১০টি পিস্তল, একটি রিভলবারসহ মোট ৩০টি অস্ত্র এবং ১৭২ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। সবশেষ ১৫ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ সীমান্ত থেকে চারটি বিদেশি পিস্তল, ৯টি ম্যাগাজিন ও ২৪ রাউন্ড গুলি জব্দ করে বিজিবি।

তবে তথ্য বলছে, সীমান্তে উদ্ধার হওয়া চোরাচালান করা অস্ত্রের সংখ্যার অনুপাতে জব্দ হওয়া এসব অস্ত্রের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য।

বিজিবির চাঁপাইনবাবগঞ্জ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল কাজী মুস্তাফিজুর রহমান চরচাকে বলেন, “সীমান্তে আমাদের কড়া নজরদারি থাকার পরও অস্ত্রের চোরাচালান একেবারে বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া। চোরাকারবারিরা একেক সময় একেকটা এলাকাকে বেছে নেয় রুট হিসেবে।”

চোরাকারবারিদের কৌশলে কথা তুলে ধরে এই বিজিবি কর্মকর্তা বলেন, “দেখা যায়, আমরা এলাকায় নজরদারি বৃদ্ধি করলে তারা নতুন রুট খুঁজে নেয়। আবার অধিকাংশ অস্ত্রের চালান আসে ছোট ছোট লটে ভাগ হয়ে। যেমন ধরুন ওই পার থেকে একটি ছোট অস্ত্র প্যাকেটে করে ঢিল ছুড়ে এপারে ফেলে দেয়। এ পাশের কারবারিরা সুযোগ বুঝে সেটি কুড়িয়ে নেয়। এত বড় সীমান্ত এলাকা কে কখন কোথায় ঢিল ছুড়ে মারছে, তা মনিটর করা কতটা কঠিন, তা নিশ্চয় আপনারা বোঝেন। তবে তারা যেমন কৌশল অবলম্বন করে, তেমনি ধরার জন্য আমরাও পাল্টা কৌশল অবলম্বন করি। আমাদের নিয়মিত অভিযান হয়, অস্ত্র ধরার বাইরেও অসংখ্য চালান আমরা প্রতিরোধ করি।”

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিজিবির একটি দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, “চোরাকারবারে যেকোনো বিনিয়োগে নিশ্চিত দ্বিগুণ লাভ করা যায়। এ জন্য ঝুঁকি নিয়ে হলেও এ পেশা চালিয়ে যায় তারা।”

উদাহরণ টেনে ওই কর্মকর্তা বলেন, “একটি ইন্ডিয়ান কাঠের বাটের পিস্তল ওই পারে বিক্রি হয় বাংলাদেশি টাকায় ২০ হাজারে। এই ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করার জন্য তাদের এজেন্টসহ অনলাইন পেমেন্ট এবং বিনিময় প্রথাও আছে। এ পারের কারবারি পেমেন্ট করে দিলে ওই পার থেকে কখন কোথায় ঢিল ছোড়া হবে, তা জানিয়ে দেয়। এ পারের কারবারি সময়-সুযোগ বুঝে তা নিয়ে নেবে। এ পারের কারবারি যে এত ঝুঁকি নিল, তার মূল্য হয়ে গেল ২০ হাজার। এখন এই পিস্তলের দাম হয়ে গেল ৪০ হাজার। এরপর এখান থেকে তৃতীয় ব্যক্তির হাত ধরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছাতে এর দাম লাখ টাকার আশপাশে হয়ে যায়। তাই এই লাভের কারবার খুবই আকর্ষণীয়।”

একইভাবে নদীপথে অস্ত্রের বড় চালান আসে মিয়ানমার থেকেও।

বৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীর অবৈধ কারবার

সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আনা অস্ত্রের শেষ গন্তব্য হয় বিভিন্ন অপরাধী চক্র, সন্ত্রাসী গ্রুপ বা রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির হাত। একটি অস্ত্র পাশের দেশ থেকে শেষ গন্তব্যে পৌঁছাতে ব্যবসায়িক স্বার্থে গড়ে ওঠে সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন, যিনি এ পারের সীমান্ত থেকে কারবারির কাছ থেকে অস্ত্র কিনে তা ব্যবহারকারীর কাছে বিক্রি করেন।

বিজিবি সূত্রের দেওয়া তথ্যমতে, বাংলাদেশের কারবারির কাছে মজুত থাকা ভারতীয় পিস্তলটি ৪০ হাজার টাকায় কিনে নেন সিন্ডিকেটের আরেক ব্যক্তি। যাকে বলা হয় সাপ্লায়ার। এই সাপ্লায়ারের নিয়মিত গ্রাহক দেশের বৈধ লাইসেন্সধারী অস্ত্র ব্যবসায়ীরা।

সুনির্দিষ্ট তথ্য বলছে, দেশের লাইসেন্সধারী অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সকলেই বৈধ ব্যবসাকে শুধু সাইনবোর্ড হিসেবেই ব্যবহার করেন। আর সাপ্লায়াররা ৪০ হাজার টাকায় কেনা পিস্তলটি এই ব্যবসায়ীদের কাছে ৫০-৬০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন।

রাজধানীর মতিঝিল এলাকার একজন রাজনৈতিক কর্মীর সহযোগিতায় পল্টন এলাকার একটি বৈধ অস্ত্রের দোকানের কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে চরচা।

ওই রাজনৈতিক কর্মী ব্যক্তি অন্তত তিনটি বিদেশি অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহ করেছেন ওই দোকান থেকে। সেই দোকানের কর্মচারী জানান, দেশে লাইসেন্স পেতে জটিলতা এবং ব্যবহারকারীর উদ্দেশ্যের কারণে বৈধ অস্ত্রের বিক্রি নেই বললেই চলে।

তার মতে, দেশে এই বৈধ অস্ত্রের ব্যবসা করা মানে হলো, নিজের পৈত্রিক সম্পদ বিক্রি করে সমাজসেবা করার মতো একটি বিষয়। তিনি চরচাকে বলেন, “আপনি নিজে হিসাব করে দেখেন। দেশে কয়জন অস্ত্রের লাইসেন্স পায়? যারা পায়, তারা জীবনে একবারই অস্ত্র কেনে। এটা এমন কোনো পণ্য নয় যে, নষ্ট হয়ে যায়। তাহলে এখন বলেন, এত টাকা বিনিয়োগ করে অস্ত্রের ব্যবসায় নেমে ব্যবসায়ীরা চলে কীভাবে? এর বিপরীতে ব্ল্যাক মার্কেটটা অনেক বেশি প্রফিটেবল। প্রায় প্রতিদিন সেল থাকে।”

অস্ত্রের যোগান কীভাবে পান জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অনেকগুলো পথ আছে। সব তো আর আপনাদের বলা যাবে না, তবে বড় সোর্স হলো সাপ্লায়ার। তারা বর্ডার ক্রস মেশিন (অস্ত্র) আমাদের কাছে বিক্রি করে। আবার আমাদের কাস্টমারের ডিমান্ড থাকলে তা তাদের জানাই। সময় নিয়ে তারা ম্যানেজ করে দেয়। সাপ্লায়াররা আবার অনেক কাস্টমারের কাছে সরাসরি বিক্রি করে। এতে সাপ্লায়ারের বেশি লাভ হয়।”

সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতীয় অস্ত্র বেশি এলেও নিয়মিতই চালান থাকে গ্লক, রেমিংটন, স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন-এর মতো খুবই দামি ব্র্যান্ডের অ্যামেরিকান, ইতালিয়ান ও অস্ট্রিয়ান অস্ত্র বলেও জানান এই কর্মচারী।

তার কথা অনুযায়ী, এসব দামি উন্নতমানের অস্ত্রের গ্রাহক সাধারণত রাজনীতি সংশ্লিষ্ট মানুষ এবং শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। হাতে তৈরি অস্ত্রের নম্বর নিয়ে কোনো জটিলতা থাকে না। তবে বিদেশি অস্ত্রগুলোর আলাদা আইডেন্টিটিফিকেশন নম্বর অস্ত্রে খোদাই করা থাকে, যার সূত্র ধরে এই অস্ত্র কোথা থেকে এসেছে, তা বের করা সম্ভব। তাই এই অস্ত্রগুলোর নম্বর বিশেষ প্রক্রিয়ায় মুছে ফেলা হয়। আবার প্রয়োজনে খোদাই করে নম্বরও পরিবর্তন করা হয়, এই প্রক্রিয়াকে ‘পাঞ্চিং’ বলে থাকেন কারবারিরা।

শ্যুটিং ক্লাবের গুলি যাচ্ছে খোলা বাজারে

কয়েক মাস আগে শ্যুটিং ফেডারেশনে অনুশীলন করছিলেন দেশের প্রথম সারির একজন পুরুষ শ্যুটার। দক্ষতা বাড়ানোর জন্য ফেডারেশনের বরাদ্দের পাশাপাশি তাদের শ্যুটাররা নিজস্ব ক্লাবের পক্ষ থেকেও গুলি ব্যবহারের সুযোগ পান। ওই দিন ফেডারেশনের পক্ষ থেকে বরাদ্দ করা পাঁচটি বুলেটের পাশাপাশি ক্লাব থেকে নিয়ে আসা ৫০টিসহ মোট ৫৫টি বুলেট নিয়ে অনুশীলন শুরু করেন। ফেডারেশনের পাঁচটি এবং ক্লাবের পাঁচটি; অর্থাৎ ১০টি বুলেট ফায়ার করার পর দিনের অনুশীলন শেষ করেন এই শ্যুটার। ক্লাব থেকে আনা ৪৫টি বুলেট তিনি নিজের সঙ্গে ফেরত নিয়ে যান।

কয়েক মাস পর ফেডারেশনের অনুশীলন ফর্মে সই করতে গিয়ে অসংলগ্ন তথ্য ধরা পড়ে শ্যুটারের চোখে। তিনি দেখেন ওই নির্দিষ্ট তারিখে তার অনুশীলনে অস্বাভাবিকভাবে ফেডারেশনের বরাদ্দ থেকে ৫৫টি বুলেট খরচ দেখানো হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তের তিনি চরচাকে বলেন, “ফেডারেশনের এত বুলেট আমি খরচ করেছি, এটা হতেই পারে না। ক্লাবের যে বুলেট এনেছিলাম সেটাও খরচ হয়নি বলে ফেরত দিয়েছি। তাহলে ফেডারেশন আমার নামে এত বুলেটের ব্যবহার দেখাল কীভাবে? এ নিয়ে ফেডারেশনে অভিযোগ দিয়েও কোনো সুরাহা হয়নি। তারা এটিকে ধামাচাপা দিতে চায়। আসলে এভাবে গরমিল না দেখালে তাদের বাইরে সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যাবে।”

অন্য একজন সিনিয়র শ্যুটার নাম প্রকাশ না করার শর্তে চরচাকে জানান, ফেডারেশনের কর্মকর্তারা বিভিন্ন অস্ত্রের দোকানে এবং ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন ক্রেতার কাছে শ্যুটারদের অনুশীলনের গুলি বিক্রি করেন। বিশেষ করে পয়েন্ট ২২ বোরের বুলেট তারা অনৈতিকভাবে খোলা বাজারে বিক্রি করেন। ফেডারেশনের প্রতি পিস বুলেট কিনতে খরচ পড়ে ৫০ থেকে ৬১ টাকা, যা ওই অসাধু কর্মকর্তারা ৫০০ টাকা দরে প্রতি পিস বিক্রি করে দেন। এই শ্যুটার জানান, ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের একটি বড় চুরির চেষ্টা ধরা পড়ে ২০১৯ সালে নেপালের এসএ গেমস ট্যুরে। তখন অনুশীলনের জন্য ১৫ হাজার পিস রাইফেলের বুলেট নেপালে যাওয়ার কথা থাকলেও তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক কৌশলে পাঁচ হাজার পিস নিজের কাছে রেখে দেন, কিন্তু চালানে দেখান ১৫ হাজার পিস। ভুলে বুলেটের লাগেজ এয়ারপোর্টে থেকে যায়, আর শ্যুটাররা চলে যান নেপালে। পরবর্তী ফ্লাইটে ওই লাগেজ পাঠানোর জন্য চেকিংয় অসঙ্গতি ধরা পড়ে। এ সময় ১৫ হাজারের চালানে ১০ হাজার বুলেটের বিষয়টি সামনে এলে মনের ভুলে এমনটা হয়েছে বলে ওই তত্ত্বাবধায়ক এবং ফেডারেশন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন।

এদিকে পল্টনের অস্ত্রের দোকানের কর্মচারীর তথ্যেও এমন ঘটনার সত্যতা মেলে। তিনি নিশ্চিত করেন, গুলির বড় সরবারহ নিশ্চিত হয় ফেডারেশন ও ক্লাবগুলোর কর্মকর্তাদের মাধ্যমেই।

আবার প্রতিবেদনে মতিঝিল এলাকার যে রাজনৈতিক কর্মীর সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে, তিনি নিজেও একজন সৌখিন শিকারি। তিনি বছরে কয়েকবার অবকাশ যাপনের জন্য শিকার করতে ভ্রমণে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকা, বিভিন্ন চর ও ভোলার মনপুরা দ্বীপে যান। ফেডারেশনের একজন বড় কর্মকর্তার কাছ থেকেই সরাসরি তিনি এসব বুলেটের সরবারহ পান।

৫ আগস্টের পর দেশের বিভিন্ন থানা ও পুলিশফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া অস্ত্রের সব এখনো উদ্ধার হয়নি। ছবি: সংগৃহীত
৫ আগস্টের পর দেশের বিভিন্ন থানা ও পুলিশফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া অস্ত্রের সব এখনো উদ্ধার হয়নি। ছবি: সংগৃহীত

তবে অবৈধভাবে বুলেট বিক্রির বিষয়টি উড়িয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ শ্যুটিং ফেডারেশনের অ্যাডহক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আলেয়া ফেরদৌসী। তিনি চরচাকে বলেন, “ফেডারেশন থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে কিংবা অবৈধভাবে বুলেট হস্তান্তরের কোনো সুযোগ নেই। ক্লাবগুলো ফেডারেশনের কাছ থেকে গুলি কেনে। তারা কোনো অনিয়ম করলেও করতে পারে, তা আমার জানা নেই।”

পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র কোথায়

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর দেশের ৪৬০টি থানা ও ১১৪টি ফাঁড়িতে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট হয়। এসব ঘটনায় ৫ হাজার ৭৫৩টি অস্ত্র লুট হয়।

এই লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে অন্তত ১৩০০ অস্ত্রের খোঁজ এখনো মেলেনি। যদিও এ সংখ্যা নিয়ে সংশয় রয়েছে। দেড় বছরেও এসব অস্ত্র উদ্ধার না হওয়ায় এগুলো উদ্ধারের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। গোয়েন্দসূত্র বলছে, এগুলো ইতিমধ্যেই অপরাধীদের হাতে চলে গেছে। কিছু অস্ত্র পার্শ্ববর্তী দেশে পাচারও হয়েছে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএমপির একজন দায়িত্বশীল গোয়েন্দা কর্মকর্তা চরচাকে বলেন, “পুলিশের অস্ত্র যেগুলো উদ্ধার হয়নি সেগুলো আর সহজে উদ্ধার হবে না। এগুলো দুই ধরনের অপরাধীদের হাতে পড়েছে। এক হলো স্থানীয় অপরাধী, যারা সামনের নির্বাচনকে টার্গেট করে রাজনৈতিকভাবে ভাড়ায় পরিচালিত হবেন। আরেকটি অংশ গেছে জঙ্গি-উগ্রবাদীদের হাতে। তারা তাদের সময়-সুযোগ বুঝে এগুলো ব্যবহার করবে। চোরা কারবারিরা একটা একটা করে অস্ত্র নিয়ে আসে, আর থানা লুটের ঘটনায় অপরাধীরা অস্ত্র ভাণ্ডার পেয়ে গেছে, তারা এ সুযোগ মিস করবে কেন?”

সম্পর্কিত