খরচের দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলে ‘হাদির ঘনিষ্ঠ হয়’ শ্যুটার!

ইনকিলাব মঞ্চের কয়েকজন জানিয়েছেন, অল্প কয়েক দিন আগেই আগেই ফয়সালের পরিচয় হয় ওসমান হাদির।

সামদানী হক নাজুম, ঢাকা
সামদানী হক নাজুম, ঢাকা
খরচের দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলে ‘হাদির ঘনিষ্ঠ হয়’ শ্যুটার!
পুলিশ বলছে, গত ৯ ডিসেম্বর ওসমান হাদির প্রচারের পরিকল্পনা মিটিংয়ে অংশ নেন হত্যাকারী। ছবি: সংগৃহীত

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির নির্বাচনী প্রচারের খরচের দায়িত্ব নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ঘনিষ্ঠ হন তাকে গুলি করা ব্যক্তি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং হাদির সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

পরিচয়ের সাত দিনের মাথায় হাদির মাথায় গুলি করা হয়। এই শ্যুটারের পরিচয় নিশ্চিত হয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। পুলিশসহ একাধিক বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, গুলি চালানো ব্যক্তির নাম ফয়সাল করিম মাসুদ। তার নামে একাধিক অস্ত্র এবং চাঁদাবাজি মামলা রয়েছে। সবশেষ ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে একটি প্রতিষ্ঠানে অস্ত্র দেখিয়ে টাকা লুটের ঘটনায় র‍্যাব গ্রেপ্তার করেছিল ফয়সালকে। তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ধারণা নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের সঙ্গেও জড়িত তিনি।

ইনকিলাব মঞ্চের কয়েকজন জানিয়েছেন, অল্প কয়েক দিন আগেই ফয়সালের সঙ্গে পরিচয় হয় ওসমান হাদির।

হামলার পরিকল্পনা ছিল ৪ ডিসেম্বর

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ফয়সাল করিম মাসুদের সঙ্গে ওসমান হাদির পরিচয় হয় গত ৪ ডিসেম্বর। রাজধানীর বাংলামোটরে ইনকিলাব মঞ্চের কালচারাল সেন্টারে তিন যুবকসহ হাদির সঙ্গে দেখা করতে আসেন ফয়সাল করিম। ওই দিনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এসেছে চরচার হাতে। সেখানে দেখা যায়, রাত সাড়ে আটটার পর তিন যুবককে সঙ্গে নিয়ে কালচারাল সেন্টারে উপস্থিত হন ফয়সাল। হাদিকে সমর্থন করেন এবং হাদির ফেসবুক পোস্ট দেখে তার নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে চান এমন কথা বলে হাদির সঙ্গে প্রথম পরিচিত হন ‘শ্যুটার ফয়সাল করিম’। পরদিন সেগুনবাগিচা এলাকায় হাদি প্রচার চালান, সেখানে কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে হাদির হয়ে কাজ করেন ফয়সাল।

তবে ৪ ডিসেম্বরই হাদিকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল বলে মনে করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ যাচাই করার সময় হাদির সঙ্গে ফয়সালের আলাপচারিতার সময় অন্য দুজনের অবস্থান এবং আরেকজনের লিফট আটকে রাখার চেষ্টা দেখে এমনটা মনে করছে পুলিশ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “ওই দিন অনুকূল পরিস্থিতি না থাকায় হাদির ওপর হামলা চালাতে ব্যর্থ হয় ফয়সাল। তাই তাৎক্ষণিকভাবে পরদিন সেগুনবাগিচার জনসংযোগে উপস্থিত থাকার কথা বলে সেখান থেকে চলে আসে।”

পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, হামলার আগ পর্যন্ত হাদির সঙ্গে অন্তত তিন দিন প্রচার কার্যক্রমে ফয়সালকে দেখা যায়। গত ৯ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৮টার পর কালচারাল সেন্টারে হাদির প্রচারের পরিকল্পনা মিটিংয়ে অংশ নেয় ফয়সাল। ওই দিনই তিনি হাদির সকল নির্বাচনী পোস্টার-ব্যানার তৈরির খরচসহ অনুসাঙ্গিক খরচ বহনের প্রস্তাব দেন। হাদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে এটিকে ফয়সালের কৌশল হিসেবে মনে করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

সবশেষ গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে জুমার নামাজের আগ পর্যন্ত মতিঝিল এলাকায় প্রচার চালান ওসমান হাদি। পুরো সময় সঙ্গে থেকে প্রচারের কাজ করে ফয়সাল এবং তার সহযোগী। প্রচার শেষে মতিঝিল জমিয়া উলুম মাদ্রাসায় হাদিসহ অন্যরা নামাজ পড়লেও ফয়সাল এবং তার সহযোগী মাদ্রাসার বাইরে অপেক্ষা করেন। নামাজ শেষে মতিঝিল থেকে বাংলামোটরে নিজেদের কালচারাল সেন্টারে যাওয়ার পথেই হামলার শিকার হন হাদি।

হাদির সঙ্গে ফয়সালের পরিচয় থেকে শুরু করে হামলা পর্যন্ত পুরো ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। সেই সঙ্গে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ এবং ইনকিলাব মঞ্চের একাধিক সদস্যও এই ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে চরচাকে নিশ্চিত করেন।

ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য রাকিব শিকদার রাব্বী বলেন, “প্রথমে আমরা তাদের নির্বাচনী ক্যাম্পে যোগ দেওয়াটা স্বাভাবিক ভেবেছিলাম, কারণ হাদি ভাই ডিক্লেয়ার করেছিলেন যে কেউ তার প্রচারে অংশ নিতে পারবে। কিন্তু হামলার পর সেন্টারের ফুটেজ ক্রসচেক করতে গিয়ে বোঝা গেল তারা ৪ তারিখও হাদি ভাইকে হত্যার উদ্দেশ্যেই এসেছিল।”

দুজনই শনাক্ত গ্রেপ্তার যেকোনো সময়

এদিকে ওসমান হাদির ওপর হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হামলাকারী ফয়সাল এবং তার সহযোগীকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। মোটরসাইকেল চালকের যে পরিচয় পেয়েছে পুলিশ তার সঙ্গে একাধিক ব্যক্তির মিল থাকায় তার তথ্য প্রচার না করার অনুরোধ জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে ঢাকার বাইরে তাদের দুজনের সবশেষ অবস্থান নিশ্চিত হওয়া গেছে। শনিবার যেকোনো সময় অভিযান চালাবে পুলিশ। এদিকে শুক্রবার রাতে দুই অপরাধী শনাক্তের বিষয়ে গণমাধ্যমকে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, যেকোনো সময় দুজন গ্রেপ্তার হবেন।

ডিএমপির অপরাধ বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার এস.এন. মো. নজরুল ইসলাম চরচাকে বলেন, “ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনাটি দেশের মানুষকে অনেক বড় ধাক্কা দিয়েছে। আমরাও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত কাজ চালাচ্ছি। জড়িতরা এরই মধ্যে শনাক্ত, আশা করছি খুব দ্রুত তারা গ্রেপ্তার হবে।”

যেভাবে শনাক্ত অপরাধীরা

শুক্রবার দুপুর ২টা ২১ মিনিটে রাজধানীর পল্টন এলাকার বক্স কালভার্ট রোডে হামলার শিকার হন ওসমান হাদি। গতবছর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সরব উপস্থিতি এবং পরে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন কর্মসূচি ও বক্তব্যের কারণে পরিচিত পান হাদি।

শুক্রবার তার ওপর গুলি চালানোর পরপরই ঘটনাস্থল ও আশপাশের সিসি টিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। ফুটেজ বিশ্লেষণ করে হামলাকারীদের ব্যবহার করা হোন্ডা হর্নেট সিরিজের মোটরসাইকেলটি চিহ্নিত হয়। একই সঙ্গে হামলাকারী এবং মোটরসাইকেল চালকের পরিধেয় পোশাকের রং, ধরন সম্পর্কে ধারণা পায় পুলিশ। দুই হামলাকারীর উপস্থিতি নিশ্চিত হতে সকালে মতিঝিল এলাকায় চালানো হাদির প্রচারণার একাধিক ছবি এবং ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে তারা। সেখানে পোশাক দেখে দুই হামলাকারীর উপস্থিতির প্রমাণ পায় তদন্ত কর্মকর্তারা। পরে রাতে ইনকিলাব মঞ্চের কালচারাল সেন্টারের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে শ্যুটারের স্পষ্ট ছবি মেলে। তারপর ডিএমপির অপরাধী ডেটাবেইজ থেকে ফয়সালের পরিচয় নিশ্চিত হয় পুলিশ।

সম্পর্কিত