ডয়চে ভেলের বিশ্লেষণ
চরচা ডেস্ক

সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং কূটনৈতিক মিশনের সুরক্ষা নিয়ে বিরোধের জেরে ভারত ও বাংলাদেশ একে অপরের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এর ফলে চিকিৎসার জন্য যাতায়াত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং দুই দেশের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটেছে।
গত ২২ ডিসেম্বর ভারতের নয়াদিল্লি ও আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনের সামনে বিক্ষোভ হওয়ার পর ঢাকা সেখানে তাদের ভিসা ও কনস্যুলার সেবা বন্ধ করে দেয়। এর ফলে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক এখন এক সংকটময় অবস্থায় রয়েছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার পর, ভারতও চট্টগ্রামের ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রে তাদের কার্যক্রম স্থগিত করেছে।
৩২ বছর বয়সী হাদি ছিলেন ভারতের একজন কট্টর সমালোচক। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, যার ফলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে।
গত ১৮ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাদি মারা যান। এর এক সপ্তাহ আগে ঢাকায় মোটরসাইকেলে আসা এক মুখোশধারী ব্যক্তি তার মাথায় গুলি করেছিল।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এই হত্যাকাণ্ডকে একটি ‘পরিকল্পিত হামলা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তার মতে, একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত নির্বাচনকে বানচাল করার উদ্দেশ্যে এই হামলাটি চালিয়েছে।
পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ
বাংলাদেশে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ময়মনসিংহে দিপু চন্দ্র দাস (২৫) নামের এক হিন্দু যুবককে গণপিটুনি দিয়ে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বেড়েছে।
দিপু দাসের হত্যার বিচারে ভারতের কলকাতা ও হায়দরাবাদসহ বিভিন্ন স্থানে প্রভাবশালী হিন্দু সংগঠনগুলো বিক্ষোভ করেছে। বিক্ষোভকারীদের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ড ও ব্যানারে ‘বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন ভারত সহ্য করবে না’ সহ বিভিন্ন স্লোগান দেখা গেছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং উদ্বেগের কথা জানাতে চলতি সপ্তাহের শুরুতে দিল্লি ও ঢাকা একে অপরের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে। এই পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপের পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং কূটনৈতিক মিশনের সুরক্ষা নিয়ে চলমান অস্থিরতা শেষ পর্যন্ত উভয় দেশের ভিসা সেবা স্থগিতের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে।
ভিসা বন্ধের এই সিদ্ধান্তের ফলে ভারতে চিকিৎসা নিতে ইচ্ছুক হাজার হাজার বাংলাদেশি চরম বিপাকে পড়েছেন, যা বিষয়টিকে একটি মানবিক সংকটে রূপ দিয়েছে। তবে ঢাকায় ভারতীয় স্থাপনার সামনে বিক্ষোভ এবং ভারতে বাংলাদেশি মিশনের সামনে বিক্ষোভকে এক করে দেখার বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে ভারত সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, “ভারত বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর কড়া নজর রাখছে। আমাদের কর্মকর্তারা বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন এবং সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়ে আমাদের তীব্র উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। আমরা দিপু চন্দ্র দাস হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছি।”
উত্তেজনা শুরু হওয়ার পর থেকে সাধারণ মানুষের ওপর এই ভিসা স্থগিতের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি পড়ছে। ভারত প্রতিদিন প্রায় ১,৫০০ বাংলাদেশিকে ভিসা দিচ্ছিল, যেখানে চিকিৎসা ও জরুরি ভিসাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হতো। এর ফলে নতুন ভিসা, পুরনো রোগীদের ফলো-আপ এবং জরুরি সেবার অপেক্ষায় থাকা রোগীদের পুরো প্রক্রিয়াটিই এখন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
তবে এ ধরনের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং শেখ হাসিনার পতনের পর নিরাপত্তার অজুহাতে সারা বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় ভিসা সেন্টারগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
কঠিন পারস্পরিক নির্ভরশীলতা
বিশেষজ্ঞ এবং সাবেক কূটনীতিকরা মনে করছেন, বর্তমান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এই কূটনৈতিক টানাপোড়েন বেশ গুরুতর।
দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজ ডয়চে ভেলেকে বলেন, “ভিসা স্থগিতের এই সিদ্ধান্তটি একটি সাময়িক পদক্ষেপ, স্থায়ী কোনো বিষয় নয়।”
সঞ্জয় ভরদ্বাজ আরও বলেন, “ভারতবিরোধী বক্তব্য ও কর্মীদের নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়ায় ভারত তার চট্টগ্রাম ভিসা অফিস বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে, ভারতে বাংলাদেশের ভিসা কার্যক্রম স্থগিত করার বিষয়টি পুরোপুরি একটি পাল্টা পদক্ষেপ, যা মূলত দেশের অভ্যন্তরীণ মানুষকে সন্তুষ্ট করার জন্য করা হয়েছে।”
ভরদ্বাজ মনে করেন, ভারত ও বাংলাদেশ একটি জটিল পারস্পরিক নির্ভরশীলতার মধ্যে রয়েছে। তিনি বলেন, “ব্যবসা-বাণিজ্য, ট্রানজিট বা কানেক্টিভিটি সব ক্ষেত্রেই ভারতের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশ চলতে পারে না।”
তার মতে, “ভিসা নিয়ে এই অচলাবস্থা সাধারণ মানুষের জন্য ভোগান্তির হলেও এটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বা বাণিজ্যকে পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত করবে না। উভয় পক্ষই এর গুরুত্ব বোঝে। এই ভিসা বন্ধের ফলে মানুষের কষ্ট হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সম্পর্কের মূল ভিত্তি এতে ভেঙে পড়বে না।”
চিকিৎসা সেবায় নেতিবাচক প্রভাব
সাম্প্রতিক এই সংঘাতটি মূলত গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা সম্পর্কের অবনতিরই বহিঃপ্রকাশ। শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে এই সম্পর্কের আরও দ্রুত অবনতি হয়েছে। ভারত বাংলাদেশে হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে, অন্যদিকে ঢাকা এটিকে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছে এবং এর প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী ডয়চে ভেলেকে বলেন, “ভারতের ভিসা কার্যক্রম বন্ধ করা ছিল একটি সাময়িক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, যা আমাদের মিশন ও ভিসা কেন্দ্রগুলোর ওপর আসা বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্য হুমকির প্রতিক্রিয়ায় নেওয়া হয়েছিল। চট্টগ্রামের পরিস্থিতি এখনও ঝুঁকিপূর্ণ থাকায় সেটি বাদে বাকি সব জায়গায় কার্যক্রম পুনরায় চালু করা হয়েছে।”
পিনাক রঞ্জন মনে করেন, বাংলাদেশের এই প্রতিক্রিয়াটি কেবল একটি পাল্টা প্রতিশোধ। তিনি বলেন, “তারা একটি মিথ্যা তুলনা তৈরি করার চেষ্টা করছে যে, ভারতে তাদের মিশনগুলোও একই ধরনের বিপদের সম্মুখীন। এটি মূলত তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ মানুষের জন্য তৈরি করা একটি সাজানো গল্প, যার পেছনে প্রকৃত কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই।”
পিনাক আরও বলেন, “হ্যাঁ, উদ্বেগের কথা জানানোর জন্য হাই কমিশনারদের তলব করা একটি স্বাভাবিক কূটনৈতিক নিয়ম। তবে প্রকৃত নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং রাজনৈতিক অবস্থানের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।”
জিন্দাল স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের বাংলাদেশ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ শ্রীরাধা দত্ত বলেন, “বর্তমান এই সংকট কয়েক দিনের মধ্যে হয়তো কমে আসবে, কিন্তু ঢাকায় একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না।”
শ্রীরাধা দত্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, “কিছু উগ্র গোষ্ঠী রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। এটি বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের মনোভাবের প্রতিফলন নয়।”
শ্রীরাধা দত্ত আরও বলেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা অভ্যন্তরীণ সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার পত্রিকার কার্যালয়ে যা ঘটেছে, তা সরকারের চরম অযোগ্যতা অথবা অসৎ উদ্দেশ্যকে প্রকাশ করে। বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি।”
গত ১৮ ডিসেম্বর যুবনেতা হাদির হত্যাকাণ্ডের পর ছড়িয়ে পড়া ‘দাঙ্গার’ সময় একদল জনতা সংবাদপত্রগুলোর প্রধান কার্যালয়ে ভাঙচুর, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ করে।
শ্রীরাধা দত্ত বলেন, “অচলাবস্থা এখন স্পষ্ট। বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনের বৈধতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে, অন্যদিকে ভারত একজন নির্ভরযোগ্য অংশীদারের অপেক্ষায় আছে। ঢাকা যদি সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ব্যাপারে প্রকৃত সদিচ্ছা না দেখায়, তবে দিল্লিও তাদের অবস্থান থেকে সরবে না।”
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী?
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই সহিংসতার জন্য উগ্রপন্থীদের দায়ী করেছে এবং হামলার ঘটনায় পূর্ণাঙ্গ বিচার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে সাধারণ মানুষ এবং কূটনৈতিক উভয় পর্যায়েই একে অপরকে দোষারোপ করার সংস্কৃতি ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ককে আরও খারাপ করে তুলেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভিসা সেবা স্থগিত হওয়া, রাষ্ট্রদূতদের তলব করা, কূটনৈতিক মিশনের সামনে বিক্ষোভ এবং প্রতিদিনের পারস্পরিক সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে এটি স্পষ্ট যে দুই দেশের সম্পর্ক এখন গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলী দাস ডয়চে ভেলেকে বলেন, “সাম্প্রতিক বিক্ষোভ এবং তার ফলে ভিসা স্থগিতের ঘটনা ভারত-বাংলাদেশ উত্তেজনাকে বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে গেছে।” তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভারতীয় ভিসা কেন্দ্রগুলোর ওপর যে হুমকি রয়েছে, তাতে অফিস বন্ধ রাখা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না।
রিভা গাঙ্গুলী আরও বলেন, “বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক, যা অনেকটা আইন হীনতার পর্যায়ে পৌঁছেছে। ভারতের বিক্ষোভের সঙ্গে বাংলাদেশের সহিংসতাকে তুলনা করা ঢাকার পক্ষ থেকে একটি বড় ধরনের অসততা।”
রিভা গাঙ্গুলী দাস আরও বলেন, “এখানে অনেক স্ববিরোধিতাও রয়েছে। যুবনেতা হাদি হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ দাবি করছে যে তার খুনিরা এখনো দেশের ভেতরে থাকতে পারে, আবার সরকারের অন্য কর্মকর্তারা একইসঙ্গে অভিযোগ করছেন যে, তারা ভারতে পালিয়ে গেছে।”
তবে এই তিক্ততা সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাই এই সংকট থেকে উত্তরণের সবচেয়ে পরিষ্কার পথ।
শ্রীরাধা দত্ত বলেন, “১৭ বছরের নির্বাসন কাটিয়ে বিএনপি নেতা তারেক রহমানের দেশে ফেরার প্রেক্ষাপট এখন তৈরিকরা হয়েছে। ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে সামনে রেখে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পরিস্থিতিকে ঘোলাটে এবং মেরুকরণ করার চেষ্টা করছে। তবে তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে এবং সময়মতো নির্বাচন আয়োজনে আরও জোরাল ভূমিকা রাখতে পারে।”

সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং কূটনৈতিক মিশনের সুরক্ষা নিয়ে বিরোধের জেরে ভারত ও বাংলাদেশ একে অপরের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এর ফলে চিকিৎসার জন্য যাতায়াত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং দুই দেশের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটেছে।
গত ২২ ডিসেম্বর ভারতের নয়াদিল্লি ও আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনের সামনে বিক্ষোভ হওয়ার পর ঢাকা সেখানে তাদের ভিসা ও কনস্যুলার সেবা বন্ধ করে দেয়। এর ফলে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক এখন এক সংকটময় অবস্থায় রয়েছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার পর, ভারতও চট্টগ্রামের ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রে তাদের কার্যক্রম স্থগিত করেছে।
৩২ বছর বয়সী হাদি ছিলেন ভারতের একজন কট্টর সমালোচক। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, যার ফলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে।
গত ১৮ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাদি মারা যান। এর এক সপ্তাহ আগে ঢাকায় মোটরসাইকেলে আসা এক মুখোশধারী ব্যক্তি তার মাথায় গুলি করেছিল।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এই হত্যাকাণ্ডকে একটি ‘পরিকল্পিত হামলা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তার মতে, একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত নির্বাচনকে বানচাল করার উদ্দেশ্যে এই হামলাটি চালিয়েছে।
পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ
বাংলাদেশে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ময়মনসিংহে দিপু চন্দ্র দাস (২৫) নামের এক হিন্দু যুবককে গণপিটুনি দিয়ে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বেড়েছে।
দিপু দাসের হত্যার বিচারে ভারতের কলকাতা ও হায়দরাবাদসহ বিভিন্ন স্থানে প্রভাবশালী হিন্দু সংগঠনগুলো বিক্ষোভ করেছে। বিক্ষোভকারীদের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ড ও ব্যানারে ‘বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন ভারত সহ্য করবে না’ সহ বিভিন্ন স্লোগান দেখা গেছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং উদ্বেগের কথা জানাতে চলতি সপ্তাহের শুরুতে দিল্লি ও ঢাকা একে অপরের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে। এই পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপের পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং কূটনৈতিক মিশনের সুরক্ষা নিয়ে চলমান অস্থিরতা শেষ পর্যন্ত উভয় দেশের ভিসা সেবা স্থগিতের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে।
ভিসা বন্ধের এই সিদ্ধান্তের ফলে ভারতে চিকিৎসা নিতে ইচ্ছুক হাজার হাজার বাংলাদেশি চরম বিপাকে পড়েছেন, যা বিষয়টিকে একটি মানবিক সংকটে রূপ দিয়েছে। তবে ঢাকায় ভারতীয় স্থাপনার সামনে বিক্ষোভ এবং ভারতে বাংলাদেশি মিশনের সামনে বিক্ষোভকে এক করে দেখার বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে ভারত সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, “ভারত বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর কড়া নজর রাখছে। আমাদের কর্মকর্তারা বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন এবং সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়ে আমাদের তীব্র উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। আমরা দিপু চন্দ্র দাস হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছি।”
উত্তেজনা শুরু হওয়ার পর থেকে সাধারণ মানুষের ওপর এই ভিসা স্থগিতের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি পড়ছে। ভারত প্রতিদিন প্রায় ১,৫০০ বাংলাদেশিকে ভিসা দিচ্ছিল, যেখানে চিকিৎসা ও জরুরি ভিসাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হতো। এর ফলে নতুন ভিসা, পুরনো রোগীদের ফলো-আপ এবং জরুরি সেবার অপেক্ষায় থাকা রোগীদের পুরো প্রক্রিয়াটিই এখন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
তবে এ ধরনের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং শেখ হাসিনার পতনের পর নিরাপত্তার অজুহাতে সারা বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় ভিসা সেন্টারগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
কঠিন পারস্পরিক নির্ভরশীলতা
বিশেষজ্ঞ এবং সাবেক কূটনীতিকরা মনে করছেন, বর্তমান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এই কূটনৈতিক টানাপোড়েন বেশ গুরুতর।
দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজ ডয়চে ভেলেকে বলেন, “ভিসা স্থগিতের এই সিদ্ধান্তটি একটি সাময়িক পদক্ষেপ, স্থায়ী কোনো বিষয় নয়।”
সঞ্জয় ভরদ্বাজ আরও বলেন, “ভারতবিরোধী বক্তব্য ও কর্মীদের নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়ায় ভারত তার চট্টগ্রাম ভিসা অফিস বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে, ভারতে বাংলাদেশের ভিসা কার্যক্রম স্থগিত করার বিষয়টি পুরোপুরি একটি পাল্টা পদক্ষেপ, যা মূলত দেশের অভ্যন্তরীণ মানুষকে সন্তুষ্ট করার জন্য করা হয়েছে।”
ভরদ্বাজ মনে করেন, ভারত ও বাংলাদেশ একটি জটিল পারস্পরিক নির্ভরশীলতার মধ্যে রয়েছে। তিনি বলেন, “ব্যবসা-বাণিজ্য, ট্রানজিট বা কানেক্টিভিটি সব ক্ষেত্রেই ভারতের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশ চলতে পারে না।”
তার মতে, “ভিসা নিয়ে এই অচলাবস্থা সাধারণ মানুষের জন্য ভোগান্তির হলেও এটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বা বাণিজ্যকে পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত করবে না। উভয় পক্ষই এর গুরুত্ব বোঝে। এই ভিসা বন্ধের ফলে মানুষের কষ্ট হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সম্পর্কের মূল ভিত্তি এতে ভেঙে পড়বে না।”
চিকিৎসা সেবায় নেতিবাচক প্রভাব
সাম্প্রতিক এই সংঘাতটি মূলত গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা সম্পর্কের অবনতিরই বহিঃপ্রকাশ। শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে এই সম্পর্কের আরও দ্রুত অবনতি হয়েছে। ভারত বাংলাদেশে হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে, অন্যদিকে ঢাকা এটিকে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছে এবং এর প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী ডয়চে ভেলেকে বলেন, “ভারতের ভিসা কার্যক্রম বন্ধ করা ছিল একটি সাময়িক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, যা আমাদের মিশন ও ভিসা কেন্দ্রগুলোর ওপর আসা বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্য হুমকির প্রতিক্রিয়ায় নেওয়া হয়েছিল। চট্টগ্রামের পরিস্থিতি এখনও ঝুঁকিপূর্ণ থাকায় সেটি বাদে বাকি সব জায়গায় কার্যক্রম পুনরায় চালু করা হয়েছে।”
পিনাক রঞ্জন মনে করেন, বাংলাদেশের এই প্রতিক্রিয়াটি কেবল একটি পাল্টা প্রতিশোধ। তিনি বলেন, “তারা একটি মিথ্যা তুলনা তৈরি করার চেষ্টা করছে যে, ভারতে তাদের মিশনগুলোও একই ধরনের বিপদের সম্মুখীন। এটি মূলত তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ মানুষের জন্য তৈরি করা একটি সাজানো গল্প, যার পেছনে প্রকৃত কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই।”
পিনাক আরও বলেন, “হ্যাঁ, উদ্বেগের কথা জানানোর জন্য হাই কমিশনারদের তলব করা একটি স্বাভাবিক কূটনৈতিক নিয়ম। তবে প্রকৃত নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং রাজনৈতিক অবস্থানের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।”
জিন্দাল স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের বাংলাদেশ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ শ্রীরাধা দত্ত বলেন, “বর্তমান এই সংকট কয়েক দিনের মধ্যে হয়তো কমে আসবে, কিন্তু ঢাকায় একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না।”
শ্রীরাধা দত্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, “কিছু উগ্র গোষ্ঠী রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। এটি বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের মনোভাবের প্রতিফলন নয়।”
শ্রীরাধা দত্ত আরও বলেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা অভ্যন্তরীণ সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার পত্রিকার কার্যালয়ে যা ঘটেছে, তা সরকারের চরম অযোগ্যতা অথবা অসৎ উদ্দেশ্যকে প্রকাশ করে। বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি।”
গত ১৮ ডিসেম্বর যুবনেতা হাদির হত্যাকাণ্ডের পর ছড়িয়ে পড়া ‘দাঙ্গার’ সময় একদল জনতা সংবাদপত্রগুলোর প্রধান কার্যালয়ে ভাঙচুর, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ করে।
শ্রীরাধা দত্ত বলেন, “অচলাবস্থা এখন স্পষ্ট। বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনের বৈধতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে, অন্যদিকে ভারত একজন নির্ভরযোগ্য অংশীদারের অপেক্ষায় আছে। ঢাকা যদি সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ব্যাপারে প্রকৃত সদিচ্ছা না দেখায়, তবে দিল্লিও তাদের অবস্থান থেকে সরবে না।”
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী?
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই সহিংসতার জন্য উগ্রপন্থীদের দায়ী করেছে এবং হামলার ঘটনায় পূর্ণাঙ্গ বিচার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে সাধারণ মানুষ এবং কূটনৈতিক উভয় পর্যায়েই একে অপরকে দোষারোপ করার সংস্কৃতি ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ককে আরও খারাপ করে তুলেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভিসা সেবা স্থগিত হওয়া, রাষ্ট্রদূতদের তলব করা, কূটনৈতিক মিশনের সামনে বিক্ষোভ এবং প্রতিদিনের পারস্পরিক সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে এটি স্পষ্ট যে দুই দেশের সম্পর্ক এখন গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলী দাস ডয়চে ভেলেকে বলেন, “সাম্প্রতিক বিক্ষোভ এবং তার ফলে ভিসা স্থগিতের ঘটনা ভারত-বাংলাদেশ উত্তেজনাকে বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে গেছে।” তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভারতীয় ভিসা কেন্দ্রগুলোর ওপর যে হুমকি রয়েছে, তাতে অফিস বন্ধ রাখা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না।
রিভা গাঙ্গুলী আরও বলেন, “বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক, যা অনেকটা আইন হীনতার পর্যায়ে পৌঁছেছে। ভারতের বিক্ষোভের সঙ্গে বাংলাদেশের সহিংসতাকে তুলনা করা ঢাকার পক্ষ থেকে একটি বড় ধরনের অসততা।”
রিভা গাঙ্গুলী দাস আরও বলেন, “এখানে অনেক স্ববিরোধিতাও রয়েছে। যুবনেতা হাদি হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ দাবি করছে যে তার খুনিরা এখনো দেশের ভেতরে থাকতে পারে, আবার সরকারের অন্য কর্মকর্তারা একইসঙ্গে অভিযোগ করছেন যে, তারা ভারতে পালিয়ে গেছে।”
তবে এই তিক্ততা সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাই এই সংকট থেকে উত্তরণের সবচেয়ে পরিষ্কার পথ।
শ্রীরাধা দত্ত বলেন, “১৭ বছরের নির্বাসন কাটিয়ে বিএনপি নেতা তারেক রহমানের দেশে ফেরার প্রেক্ষাপট এখন তৈরিকরা হয়েছে। ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে সামনে রেখে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পরিস্থিতিকে ঘোলাটে এবং মেরুকরণ করার চেষ্টা করছে। তবে তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে এবং সময়মতো নির্বাচন আয়োজনে আরও জোরাল ভূমিকা রাখতে পারে।”