বঙ্গবন্ধুর যে বিষয় নিয়ে বিতর্ক তুলেছিলেন মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চিফ

চরচা প্রতিবেদক
চরচা প্রতিবেদক
বঙ্গবন্ধুর যে বিষয় নিয়ে বিতর্ক তুলেছিলেন মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চিফ

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ ছিলেন এ কে খন্দকার। সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানির পরই ছিল তাঁর অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল অবদানের জন্য দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বীরত্বপূর্ণ খেতাব ‘বীরউত্তম’ আছে তাঁর। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রথম প্রধান। পরবর্তীকালে মন্ত্রী হয়েছেন, বিদেশে দায়িত্বপালন করেছেন রাষ্ট্রদূত হিসেবেও। তিনি আজ চলে গেলেন ৯৫ বছর বয়সে। পরিপূর্ণ ও সফল এক জীবন। কিন্তু এতকিছুর পরেও এ কে খন্দকার শেষ জীবনে এসে মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই এক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। যে বিতর্ক তাঁকে শেষ দিকে অনেকটাই লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়ে যায়।

২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘১৯৭১: ভেতরে–বাইরে’। সেই গ্রন্থে তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেছেন। এর পূর্বাপর বর্ণনা করতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের প্রসঙ্গ এনেছিলেন। সেখানেই তৈরি হয়েছিল বিতর্ক। অবশ্য সেই বিতর্কের একটা বড় কারণ ছিল ওই সময় এ কে খন্দকারের রাজনৈতিক পদ–পদবি।

এ কে খন্দকারের সেই বই, যেটি বিতর্ক তৈরি করেছিল।
এ কে খন্দকারের সেই বই, যেটি বিতর্ক তৈরি করেছিল।

৭ মার্চের সেই ভাষণের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এ কে খন্দকার লিখেছিলেন শেখ মুজিব নাকি ভাষণের শেষে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের সঙ্গে সঙ্গে ‘জয় পাকিস্তান’ও বলেছিলেন। বইয়ে এ তথ্য লিখে তিনি সে সময় ব্যাপক সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান যখন এই বইটি লিখছেন, তখন তিনি ছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সংসদ সদস্য ও পরিকল্পনামন্ত্রী। সে সময় তিনি সরকারের ভেতর থেকেও তীব্র আক্রমণের শিকার হন। সংসদে তাঁর উপস্থিতিতেই আওয়ামী লীগের শীর্ষ মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা তাঁকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখেন।

শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে নিজের বইয়ে কী লিখেছিলেন এ কে খন্দকার, যা নিয়ে শুরু হয়েছিল সেই বিতর্ক?

“সাতই মার্চের ভাষণটি আমি শুনেছি। এর মধ্যে যে কথাগুলো আমার ভালো লেগেছিল, তা হলো: ‘দুর্গ গড়ে তোলো’, ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তা–ই নিয়ে প্রস্তুত থাকো’, ‘শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এ সময় সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ তাঁর কাছ থেকে এ ধরনের কথাই আশা করছিল। ওই কথাগুলো শক্তিশালী ছিল বটে, তবে তা বাস্তবে রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা আওয়ামী লীগ নেতাদের ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল, কিন্তু আমার মনে হয়েছে কীভাবে স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে, তা তিনি পরিস্কার করেননি। তা ছাড়া জনগণকে যুদ্ধ করার জন্য যেভাবে প্রস্তুত করা প্রয়োজন, তা করা হয়নি। ভাষণে চূড়ান্ত কোনো দিক নির্দেশনা পাওয়া গেল না। ভাষণটির পর মানুষজন ভাবতে শুরু করল—এরপর কী হবে? আওয়ামী লীগের পূর্ব প্রস্তুতি না থাকায় যুদ্ধ শুরু করার কথা বলাও একেবারে বোকামি হতো। সম্ভবত এ কারণেই বঙ্গবন্ধু ৭ ই মার্চ সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করা থেকে বিরত থাকেন। তা ছাড়া ইয়াহিয়া খান নিজেও বঙ্গবন্ধুকে এ ধরনের ঘোষণা না দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হয়তো ঢাকায় ইয়াহিয়ার উপস্থিতিতে একটি রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণেই যে মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল, তা আমি মনে করি না। এই ভাষণের শেষ শব্দগুলো ছিল ‘জয় বাংলা’, ‘জয় পাকিস্তান’। এটি যে যুদ্ধের ডাক বা স্বাধীনতার আহ্বান, তা প্রচণ্ডভাবে প্রশ্নবিদ্ধ এবং তর্কাতীতও নয়।”

‘জয় পাকিস্তান’ স্লোগান ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিব দিয়েছিলেন কি দেননি, এই বিতর্কের পাশাপাশি তার বইয়ে উল্লেখিত মুক্তিযুদ্ধের কিছু ঐতিহাসিক ঘটনাও বিতর্ক তৈরি করে। এ কে খন্দকার বইয়ে জিয়াউর রহমানের ‘স্বাধীনতা ঘোষণা’র কথাও লিখেছিলেন, “২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের রূপ নেয়। এখান থেকে প্রথমে স্থানীয় নেতারা ও পরে মেজর জিয়াউর রহমান, বীরউত্তম (পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল ও রাষ্ট্রপতি) বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। আমি মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা শুনি এবং চট্টগ্রামে সশ্রস্ত্র যুদ্ধ শুরু হওয়ার কথা জানতে পারি। এই ভেবে উৎফুল্ল হই যে আমরা আক্রান্ত হয়ে চুপ করে নেই। আমরাও আক্রমণ শুরু করেছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।”

তাঁর লেখা আরও একটি তথ্য সমালোচনা ও বিতর্ক তৈরি করেছিল। সেটি ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিব ইপিআরের (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে চট্টগ্রামে জহুর আহমেদ চৌধুরীর কাছে শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন—এ সংক্রান্ত ব্যাপারে। এ কে খন্দকার তাঁর বইয়ে লিখেছিলেন, ‘এ তথ্যটি মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।’ এসব নিয়েই তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চাপের মুখে পড়েন তিনি।

৭ মার্চ ভাষণের প্রসঙ্গ নিয়ে সংসদে যে আলোচনা হয়েছিল, তাতে সে সময়কার ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি নিজের বক্তব্যে এ কে খন্দকারকে সরাসরি ‘জাতির জনকের খুনি মোশতাককে সমর্থনকারী’ হিসেবে বলেছিলেন।

৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে বিতর্ক তৈরি করেছিলেন এ কে খন্দকার। ছবি: বাসস
৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে বিতর্ক তৈরি করেছিলেন এ কে খন্দকার। ছবি: বাসস

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সেনা অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি মুজিব সপরিবারে নিহত হওয়ার পর নতুন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদ। সে সময় তিন বাহিনী প্রধান খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন। এ কে খন্দকার ছিলেন সে সময়ের বিমানবাহিনী প্রধান।

এই বিতর্ক এ কে খন্দকারকে মোটামুটি কোনঠাসা করে ফেলে। তিনি ক্ষমতাসীন দল ও সরকারে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। বিতর্ক শুরু হওয়ার প্রায় ৫ বছর পর ২০১৯ সালে (তিনি তখন আর মন্ত্রী নন) এক সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে তিনি বইয়ে শেখ মুজিব সংক্রান্ত তথ্যের জন্য ‘জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা’ করেন। এবং স্বীকার করেন, তিনি বইয়ে ভুল তথ্য লিখেছিলেন। সে সময় বইয়ের প্রকাশনী সংস্থা ‘প্রথমা’ বইয়ের প্রথম সংস্করণ বাজার থেকে তুলে নিয়েছিল। পরে বইটির সংশোধিত সংস্করণ বের হয়, তাতে ৭ মার্চের ভাষণের তথ্য থেকে বাদ পড়ে ‘জয় পাকিস্তান’ প্রসঙ্গ।

সম্পর্কিত