বাংলাদেশ কীভাবে উন্নয়নের জন্য অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বাড়াতে পারে?

বাংলাদেশ কীভাবে উন্নয়নের জন্য অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বাড়াতে পারে?
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলে পদ্মাসেতু। ছবি: বাসস

বাংলাদেশ তার উন্নয়ন যাত্রার এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছে। গত কয়েক দশকের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য হ্রাসের সাফল্যের পর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রবৃদ্ধির গতি কমে এসেছে। আর জনসংখ্যাগত লাভের সুযোগও দ্রুত সংকুচিত হয়ে উঠছে। আগামী দশকের মধ্যেই উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে এই সীমিত সময়টুকু সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগাতে হবে। কিন্তু সীমিত অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায় এই অগ্রযাত্রার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২০২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত ছিল মাত্র ৬ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ১৫ শতাংশের অর্ধেকেরও কম। এত কম রাজস্ব দিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা অবকাঠামোর মতো মৌলিক খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করা যায় না। এর ফলে দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের পথ হঠাৎ করে সংকুচিত হয়ে যেতে পারে। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বজায় রাখা, নতুন খাত সৃষ্টি করে অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করা, এবং টেকসই কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হলে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।

জাতীয় রাজস্ব ভবন। ছবি: বাসস
জাতীয় রাজস্ব ভবন। ছবি: বাসস

বাংলাদেশে এত কম রাজস্ব আদায়ের মূল কারণ করের হার কম হওয়া নয়; বরং জটিল, অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং আলাদা আলাদা ধরনের কর ব্যবস্থা। উদ্বেগের বিষয় হলো, কর ছাড়ের মোট পরিমাণ প্রায় আদায়কৃত করের সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই এলোমেলো কর কাঠামো কেবল রাজস্ব কমায় না, কর প্রশাসনে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করে এবং ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কর প্রদানকারীর সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে কম রাখে। এর সঙ্গে আছে বাণিজ্যভিত্তিক করের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা, যা উচ্চ শুল্ক ও অতিরিক্ত শুল্কের মাধ্যমে বাণিজ্যে বাধা সৃষ্টি করে এবং রপ্তানিমুখী অর্থনীতির প্রতি পক্ষপাত তৈরি করে।

এই সংকট অতিক্রম করতে হলে বাংলাদেশকে এখনই সাহসী ও ব্যাপক কর সংস্কারে এগোতে হবে। নীতিগত পরিবর্তনের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন এবং প্রশাসনিক সক্ষমতা বৃদ্ধিকে একইসঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে। কর নীতি সংস্কারের ক্ষেত্রে যেসব বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত তা হলো- কর ছাড় যৌক্তিকীকরণ, ভ্যাট ও আয়কর ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর ও দক্ষ করা, এবং শুল্ক কাঠামোকে এমনভাবে পুনর্বিন্যাস করা যাতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উৎসাহিত হয়। তবে নীতি সংস্কারকে আলাদা করে দেখা যাবে না, এগুলোকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চলমান প্রতিষ্ঠানগত রূপান্তরের সঙ্গে যুক্ত করতেই হবে। বিশেষভাবে কর নীতি প্রণয়ন ও কর প্রশাসনকে আলাদা করা এবং কর প্রশাসনের ডিজিটালকরণ আরও সম্প্রসারিত করা জরুরি।

কর ছাড় যৌক্তিকীকরণই রাজস্ব বৃদ্ধির সবচেয়ে তাৎক্ষণিক ও কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে। সরকার ‘কর ব্যয় নীতি ও ব্যবস্থাপনা কাঠামো (২০২৫)’ প্রণয়ন করেছে এই লক্ষ্যেই। কিন্তু এই নীতির সফলতা নির্ভর করবে সম্পূর্ণ ও ধারাবাহিক বাস্তবায়নের ওপর। কর ছাড়ে প্রশাসনিকভাবে সংবিধিবদ্ধ নিয়ন্ত্রক আদেশ (এসআরও) জারি করে দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ করে এটি সংসদের অনুমোদনের আওতায় আনতে হবে। প্রতিটি কর ছাড়ের জন্য খরচ-লাভ বিশ্লেষণ করতে হবে। আর প্রতি বছর কর ব্যয় প্রতিবেদন প্রকাশ করে কোন ছাড়গুলো রাখা উচিত এবং কোনগুলো বাতিল করা উচিত সে বিষয়ে স্বচ্ছতা তৈরি করতে হবে।

ভ্যাট সংস্কার এখন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। বহুমাত্রিক ভ্যাট হারকে একক হারে রূপান্তর করা জরুরি । যদিও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কিছু লক্ষ্যভিত্তিক ছাড় রাখা যেতে পারে। একই সঙ্গে ইনপুট ক্রেডিট ও রিফান্ড ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ কার্যকর করা হলে ব্যবসায়ীরা কেবল প্রকৃত মূল্য সংযোজনের ওপর কর দেবে, যা একটি ন্যায়সঙ্গত ও বৈশ্বিক মানসম্পন্ন ব্যবস্থা তৈরি করবে।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক। ফাইল ছবি
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক। ফাইল ছবি

আয়কর ব্যবস্থায়ও বড় ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন। কর্পোরেট আয়করের হার, যা বর্তমানে ২০ থেকে ৪৫ শতাংশের মধ্যে, তা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে একটি যৌক্তিক একক হারে নামিয়ে আনা দরকার। মূলধনী আয়ের করহারকে একীভূত করা উচিত, এবং ব্যক্তিগত আয়করকে আরও প্রগতিশীল করতে হলে মার্জিনাল হার পুনর্বিন্যাসের পাশাপাশি অযৌক্তিক ছাড় ও ভাতা তুলে দিতে হবে। মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে বাজারভিত্তিক স্বচ্ছ সম্পত্তি মূল্যায়ন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারলে সম্পত্তি কর রাজস্ব বৃদ্ধির একটি শক্তিশালী উৎস হতে পারে।

শুল্ক ও বাণিজ্য উন্মুক্তকরণের ক্ষেত্রেও ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হবে। জাতীয় শুল্ক নীতি (২০২৩) রপ্তানিবিরোধী পক্ষপাত কমাতে শুল্ক, প্যারা-শুল্ক ও নন-ট্যারিফ বাধা ধাপে ধাপে কমানোর দিকনির্দেশনা দিয়েছে। প্যারা শুল্ক বলতে সাধারণত এমন অতিরিক্ত বা বিশেষ শুল্ককে বোঝানো হয় যা কোনো দেশ অন্য দেশের পণ্যের ওপর আরোপ করে। ধীরে ধীরে শুল্ক কমালে রাজস্বের ওপর চাপ সহনীয় থাকবে, আর এর সঙ্গে বাণিজ্য সুবিধা ও বিনিয়োগ পরিবেশ সংস্কার একযোগে চললে এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো এনবিআর-এর প্রতিষ্ঠানগত রূপান্তর। কর নীতি প্রণয়ন এবং কর প্রশাসনের কাজকে পৃথক করলে দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব পরিকল্পনা সহজ হবে, এবং নীতি নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় স্বার্থের দ্বন্দ্বের সম্ভাবনা কমবে। এজন্য দ্রুত গেজেট প্রজ্ঞাপন জারি করে রেভিনিউ পলিসি ও রেভিনিউ ম্যানেজমেন্ট ডিভিশন গঠন এবং পৃথক সচিব নিয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি নতুন দক্ষ জনবল নিয়োগ, সংগঠন কাঠামো পুনর্গঠন এবং আচরণবিধি, অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ও দুর্নীতি প্রতিরোধ ব্যবস্থাসহ একটি শক্তিশালী সততা কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।

এই সকল প্রচেষ্টার কেন্দ্রে থাকতে হবে ডিজিটাল স্বয়ংক্রিয়করণ। একটি সম্পূর্ণ ইন্টিগ্রেটেড ও এন্ড-টু-এন্ড ডিজিটাল কর প্রশাসন ব্যবস্থা দুর্নীতির সুযোগ কমাবে, করদাতা ও কর প্রশাসনের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ কমিয়ে সেবাকে সহজ করবে, এবং করদাতার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াবে। প্রতিটি করদাতার জন্য একক ও ইউনিক টিআইএন বাধ্যতামূলক করা এ ব্যবস্থার ভিত্তি গঠন করবে।

অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বৃদ্ধির পথ নিঃসন্দেহে কঠিন। সংস্কারের পথে বাধা থাকবে, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রতিরোধও দেখা দিতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভবিষ্যৎ এবং দেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে এই পথেই এগোতে হবে। এখন যে সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হবে, তা আগামী প্রজন্মের উন্নয়নের ভিত্তি রচনা করবে।

লেখক: বাংলাদেশ ও ভুটানের জন্য বিশ্বব্যাংকের বিভাগীয় পরিচালক

সম্পর্কিত