জন্ম নৌকায়, মৃত্যুও নৌকায়, নাম নেই সরকারের খাতায়!

বরিশাল, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুরের আঞ্চলিক উপকূলীয় ভাষায় মান্তাদের ‘বেবাইজ্জা’ বলে। ‘বেবসতি’ অর্থে এটি ব্যবহার করা হয়। ‘বেবসতি’ মানে জমিজমা নেই, বসতি নেই এমন জনগোষ্ঠী।

মৃত্যুঞ্জয় রায়
মৃত্যুঞ্জয় রায়
জন্ম নৌকায়, মৃত্যুও নৌকায়, নাম নেই সরকারের খাতায়!
ছোট ছোট জাল এবং ঐতিহ্যবাহী বড়শি ব্যবহার করে মাছ ধরে মান্তা সম্প্রদায়ের মানুষ। ছবি: চরচা

বরিশাল শহরের পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার দূরের চরমোনাই ইউনিয়ন। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কীর্তন খোলা নদী। নদীর ওপর নৌকার একটি বহর নোঙর করা। স্রোতের সঙ্গে মৃদু তালে দুলছে নৌকাগুলো। এই বহরে আছে প্রায় ৩০টি নৌকা। প্রতিটিতে থাকে একটি পরিবার। জন্ম-মৃত্যু, বেড়ে ওঠা সবই নৌকায়। তাদের জীবন কাটছে পানির ওপর। তারা মান্তা সম্প্রদায়ের মানুষ।

বরিশাল সদর উপজেলার কর্ণকাঠীর আমিন নগরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কীর্তনখোলা নদীতেও দেখা মেলে চরমোনাইয়ের মতো দৃশ্যের। নদীর বুক চিরে চলা নৌকাতেই তাদের সব। মাছ ধরা তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।

ছোট ছোট জাল এবং ঐতিহ্যবাহী বড়শি ব্যবহার করে মাছ ধরে এই সম্প্রদায়ের মানুষ। বেরিয়ে যায় ভোরে। সারা দিন নদীতে যা পাওয়া যায় সন্ধ্যায় তা নিয়ে ফেরেন। সেটা দিয়েই চলে জীবন নির্বাহ।

মান্তা কারা

জার্মান সংবাদ সংস্থা ডয়েচ ভেলের ‘মান্তাদের ভাসমান জীবন’ শীর্ষক তথ্যচিত্রে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের নদীপ্রধান এলাকা বরিশালে মান্তা সম্প্রদায়ের মানুষরা ভাসমান গ্রামে থাকেন। মান্তা শব্দটি বার্মিজ মান্তাং থেকে এসেছে৷ মিয়ানমারে এই নামে নদীতে বাস করা একটি জাতি গোষ্ঠী রয়েছে। তবে বাংলাদেশের মান্তারা সেই সম্প্রদায়ের নয়। তারা নিজেদেরকে ভূমিহীন বলেন।

স্থানীয় এনজিওদের তথ্য বলছে, বরিশাল, ভোলা ও পটুয়াখালী জেলাজুড়ে আনুমানিক আট থেকে ১০ হাজারেরও বেশি মান্তা বসবাস করে। তাদের নিয়ে কাজ করা হাতেগোনা কয়েকটি সংস্থার মধ্যে একটি চন্দ্রদ্বীপ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির (সিডিএস) হিসাবে শুধুমাত্র বরিশাল সদর উপজেলাতেই প্রায় এক হাজার মান্তা বাস করেন।

বরিশালের সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য মতে ৩৫০টি পরিবারের বেশি মান্তা রয়েছে বরিশাল জেলার বিভিন্ন নদীতে।

বরিশাল, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুরের আঞ্চলিক উপকূলীয় ভাষায় মান্তাদের ‘বেবাইজ্জা’ বলে। ‘বেবসতি’ অর্থে এটি ব্যবহার করা হয়। ‘বেবসতি’ মানে জমিজমা নেই, বসতি নেই এমন জনগোষ্ঠী।

শুধু বরিশাল নয় ভোলার তজুমদ্দিন, চরফ্যাশন, দৌলতখানসহ সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়; পটুয়াখালীর গলাচিপা, রাঙ্গাবালী, চরমোন্তাজ; বরিশালের মুলাদী, মেহেন্দীগঞ্জ, বানারীপাড়া উপজেলায়ও তাদের বসতি আছে। এ ছাড়া মান্তারা থাকে লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীর হাট, রায়পুরের নাইয়াপাড়া, কমলনগরের মতিরহাট, রামগতি, চর আলেকজান্ডারের বিভিন্ন এলাকায়।

, মান্তারা মূলত নদী ভাঙনের শিকার। নদী গর্ভে জমি-জিরাত বিলীন হয়ে যাওয়ায় তারা বাস্তুচ্যুত। ছবি: থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন
, মান্তারা মূলত নদী ভাঙনের শিকার। নদী গর্ভে জমি-জিরাত বিলীন হয়ে যাওয়ায় তারা বাস্তুচ্যুত। ছবি: থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন

থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবদনে বলা হয়েছে, মান্তারা মূলত নদী ভাঙনের শিকার। নদী গর্ভে জমি-জিরাত বিলীন হয়ে যাওয়ায় তারা বাস্তুচ্যুত। কয়েক প্রজন্ম ধরে তারা নদীবাসী।

গত কয়েক বছরে কিছু মানুষ নানা উপায়ে পরিচয়পত্র সংগ্রহ করলেও সেটা সংখ্যায় নগন্য। এছাড়া সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পে কিছু মানুষ বাড়ি পেলেও তা হাতে গোনা।

থেকেও নেই তারা

মান্তা সম্প্রদায়ের মানুষরা জানান, তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নেই। নেই মাছ ধরার সরকারি কার্ড। কেউ কোনো সুরক্ষাভাতাও পান না। তাদের অভিযোগ, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের কাছে সাহায্য চাইলে এনআইডি না থাকায় তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তাদের সন্তানদের জন্য নেই কোনো স্কুল। অসুস্থদের জন্য নেই চিকিৎসার ব্যবস্থা।

জীবন সংগ্রামের প্রতিটি ধাপেই যাদের উপস্থিতি সবার সামনে সেই মান্তাদের অস্তিত্ব সরকারি খাতায় নেই। নদীর বুকে বসবাস করা মান্তারা সরকারি রেকর্ডে অদৃশ্যই রয়ে গেছেন যেন। তাদের নিজস্ব জমি নেই। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা ভূমিহীন এবং সরকারি দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য। অন্যরা স্বাভাবিকভাবেই যে অধিকার ভোগ করে, মান্তারা তা পান না।

আমিন নগরের ৩০ বছর বয়সী মর্জিনা বেগম চরচাকে বলেন, “একদিকে শীত পড়ছে আরেক দিকে নদীর পানি ঠান্ডা হচ্ছে। এসবের ভিতর গত সপ্তাহ থেকে আমার ছেলের ঠান্ডা লেগেছে। আমি তাকে স্থানীয় একটি ফার্মেসি থেকে ওষুধ এনে দিয়েছি। কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে ঠিক হচ্ছে না। কাছে টাকা না থাকায় হাসপাতালেও নিতে পারছি না।”

মান্তা সম্প্রদায়ের প্রতিটি নৌকা বহরে একজন সর্দার থাকেন। তিনিই দৈনন্দিন বিষয়গুলো দেখভাল করেন।

মান্তাদের প্রতি নৌকাবহরে থাকেন একজন সর্দার। ছবি: আইসিসিসিএডি
মান্তাদের প্রতি নৌকাবহরে থাকেন একজন সর্দার। ছবি: আইসিসিসিএডি

মর্জিরা বেগমের বহরের সরদার ইকবাল মিয়া বলেন, “এই সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ পুরুষ ও নারী নিরক্ষর। তারা নম্বর চেপে কল দিতে পারেন না। এখানকার বাচ্চারা স্কুলে যায় না। যাবে কীভাবে, ভর্তি হওয়ার জন্য যেসব কাগজ লাগে সেসবই নেই আমাদের। বাপ-মায়েরই কাগজ নেই। বাচ্চার থাকবে কীভাবে?”

দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীর অববাহিকায় মান্তাদের জীবন নতুন নয়। তবে জলজীবী এসব মানুষকে ডাঙায় এনে পুনর্বাসনের কোনো উদ্যোগ এত বছরেও দেখা যায়নি।

মান্তা সম্প্রদায়ের শিশুরা খুব ছোটবেলাতেই নদীর সঙ্গে পরিচিত হয়ে যায়। তারা হাঁটতে শেখার পরই নদীতে সাঁতার কাটতে ও নৌকা চালাতে শেখে। তাদের কেউই কখনো শ্রেণিকক্ষের ভেতরটা দেখে না। তাদের বাবা মায়ের এনআইডি না থাকায় তাদেরও জন্মনিব্ধন কার্ড করতে পারেন না। কিছু বেসরকারি সংগঠন বা ব্যক্তি উদ্যোগে অল্প কিছু শিশু পড়াশোনা করতে পারে মাত্র।

আমিন নগরে নদীর পাড়ে মান্তা সম্প্রদায়ের কয়েকটি পরিবার সরকারি খাস জমিতে ছোট ছোট করে কুঁড়েঘর তুলেছে। সারাদিন নৌকায় মাছ ধরে এই ঘরের ভেতর রাত্রি যাপন করেন। এই ঘরগুলোও তাদের স্থায়ী বা দীর্ঘমেয়াদি কোনো নিশ্চয়তাও দেয় না।

এমনই এক ঘরের বাসিন্দা জলিল উদ্দিন চরচাকে বলেন, “আমরা ভূমিহীন। আমরা অনেকবার জমি চেয়েছি, কিন্তু কেউ সাহায্য করে না। নৌকার ভিতর রাতের বেলা থাকাও কষ্টের। এজন্য আমরা এই নদীর পাড়ে ছোট করে ঘর বানায় নিয়েছি।”

জন্ম, মৃত্যু বেড়ে ওঠা সবাই নৌকায়। নৌকাতেই কাটে মান্তা নারীদের জীবন। ছবি: চরচা
জন্ম, মৃত্যু বেড়ে ওঠা সবাই নৌকায়। নৌকাতেই কাটে মান্তা নারীদের জীবন। ছবি: চরচা

যা বলছে সরকারি-বেসরকারি দপ্তর

বরিশাল সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আজহারুল ইসলাম বলেন, মান্তা সম্প্রদায় থেকে কোনো সরকারি খাস জমির জন্য আবেদন তিনি পাননি।

মান্তারা সরকারিভাবে জেলে হিসেবে স্বীকৃত নন। যখন ২২ দিন ধরে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকে তখন তারা রেশন বা সরকারি সহায়তা পান না।

মান্তারা কেন সরকারি সহায়তা পান না জানতে চাইলে বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য কর্মকর্তা মো. আনিসুজ্জামান বলেন, “তারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যান। এ কারণেই চেয়ারম্যান এবং ইউপি সদস্যরা তাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে দ্বিধায় থাকেন।”

বাবা-মায়ের এনআইডি না থাকায় ক্লাসরুমে ভেতরটা দেখতে পায় না মান্তা শিশুরা। ছবি: চরচা
বাবা-মায়ের এনআইডি না থাকায় ক্লাসরুমে ভেতরটা দেখতে পায় না মান্তা শিশুরা। ছবি: চরচা

বরিশালের সচেতন নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক গাজী জাহিদ হোসেন বলেন, শিক্ষা, পরিচয়পত্র বা সরকারি সহায়তার অভাবে মান্তা সম্প্রদায় দেশের সবচেয়ে উপেক্ষিত ও অদৃশ্য গোষ্ঠীর মধ্যে একটি।

তিনি আরও বলেন, “মান্তাদের নেই জমি, নেই স্কুল, নেই হাসপাতাল, নেই কোনো স্বীকৃতি। তারা নদীর মানুষ। নদীর পানিতে নৌকায় তাদের জন্ম, সেখানেই তারা বেঁচে থাকেন, সেখানেই তারা মারা যান। তাদের দিকে কারো মনযোগ নেই।”

মান্তাদের এনআইডি না থাকার সবচেয়ে প্রধান কারণ হলো তাদের স্থায়ী আবাস নেই। এই কারণেই তাদের শনাক্ত করা কঠিন।

বরিশাল জেলার সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা মো. রোকানুজ্জামান চরচাকে বলেন, “মান্তা জনগোষ্ঠী যেহেতু নদীতে ভেসে বেড়ায় এবং স্থায়ী আবাস নেই, তাই তাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। প্রথমেই তাদের একটি নির্দিষ্ট স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে হবে। এরপর স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে শনাক্তকরণের সনদ সংগ্রহ করে নিজ নিজ উপজেলার নির্বাচন অফিসে জমা দিলেই ভোটার হওয়া যাবে।”

ছবি: চরচা
ছবি: চরচা

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে তাদের ভোটার করা সম্ভব নয় বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

সিডিএস’র গবেষণা বলছে, সব সমস্যার মূলে রয়েছে মান্তাদের থাকার জায়গার অভাব। তাদের যেমন কোনো জমি নেই, তেমনই তারা কখনোই স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার করতে পারে না। এ ভূমিহীন জনগোষ্ঠীকে সরকারি খাস জমির বন্দোবস্ত করে মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে।

দীর্ঘদিন ধরে মান্তা সম্প্রদায়দের নিয়ে কাজ করা সাংবাদিক সাঈদ পান্থ চরচাকে বলেন, “মান্তাদের কোনো এনআইডি নেই। আমরা উদ্যোগ নিয়ে অল্প কিছু লোকের পরিচয়পত্র করে দিয়েছিলাম। কিন্তু তাদের এখনো স্থায়ীভাবে থাকার জায়গা নেই। মান্তাদের জীবনমান উন্নয়ন করতে হলে তাদের এনআইডি দিতে হবে। স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে এই ভূমিহীন জনগোষ্ঠীকে সরকারি খাসজমির বন্দোবস্ত দিয়ে মূলধারায় ফিরিয়ে আনা জরুরি।”

সম্পর্কিত