‘পুনর্কল্পনায় সুলতানার স্বপ্ন’ আসলে কী বলছে আমাদের?

‘পুনর্কল্পনায় সুলতানার স্বপ্ন’ আসলে কী বলছে আমাদের?
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ‘পুনর্কল্পনায় সুলতানার স্বপ্ন’ শীর্ষক এ প্রদর্শনী শুরু হয়েছে ৬ ডিসেম্বর। ছবি: চরচা

পুরুষের বুকে লেখা ‘নির্যাতন’, ‘পারিশ্রমিক’, ‘নারী শ্রম’, ‘সম্ভাবনা’ ইত্যাদি শব্দ। ফটোগ্রাফ। সিলিং থেকে ঝুলছে ছবিগুলো। এ যেন এক প্রশ্নমালা। প্রশ্নটি পুরুষের দিকেই, নাকি নারীর দিকেও? ভাবাচ্ছে বটে। হেলাল সম্রাটের এ কাজ প্রশ্নের সামনেই দাঁড় করায়। শিল্পী নিজে এই কাজকে বলছেন–‘হয়তো তুমি শিকারী বা শিকার’।

পাশ ফিরতেই নজর যায় ‘পিনোন’–এর দিকে। চাকমা ঐতিহ্যবাহী বুননে গড়া এ শিল্পকর্মকে শিল্পী জয়তু চাকমা বলছেন–যেখানে সুলতানার স্বপ্ন বিরাজমান। শিরোনাম মগজে নাড়া দিয়ে বলে যায়–দেখো তোমার ভূখণ্ডেই কিন্তু নারী ও পুরুষের সহাবস্থানের উদাহরণ আছে। এই দেখো তারই এক রূপ দুলছে তোমার সম্মুখেই।

দূর থেকে ইশারা দিয়ে ডাকে শিল্পী জাফরিন গুলশানের রেহাল দিয়ে করা ইনস্টলেশন। এদিকে রাজীব দত্তের ‘সুলতানাদের আকাশের আলো ও আঁধার’ শিল্পকর্মের সামনে দাঁড়ালে সুলতানাদের সামনের সেই আকাশের দেখা পাওয়াটা আয়াসসাধ্য হলেও বালুচাপা সুলতানার বাস্তবতা ধরা দেয় অনায়াসে। আরও আছে সৈয়দ সাইফ, আশাং মং, বিলাস মণ্ডল, এ এছেন, রূপশ্রী হাজং, সুমনা আক্তার, রুক্সমিনি চৌধুরীসহ ২০ জন শিল্পীর কাজ। এ আয়োজন করেছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও কলাকেন্দ্র যৌথভাবে।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ‘পুনর্কল্পনায় সুলতানার স্বপ্ন’ শীর্ষক এ প্রদর্শনী শুরু হয়েছে ৬ ডিসেম্বর। এ বছর রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের ‘সুলতানার স্বপ্ন’ প্রকাশের ১২০ বছর পূর্তি। সুলতানার স্বপ্ন ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড (এশিয়া প্যাসিফিক) স্বীকৃতি পাওয়ার পর তা উদ্‌যাপনেই এ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ‘পুনর্কল্পনায় সুলতানার স্বপ্ন’ শীর্ষক এ প্রদর্শনী শুরু হয়েছে ৬ ডিসেম্বর। ছবি: চরচা
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ‘পুনর্কল্পনায় সুলতানার স্বপ্ন’ শীর্ষক এ প্রদর্শনী শুরু হয়েছে ৬ ডিসেম্বর। ছবি: চরচা

এ প্রদর্শনী নানা প্রশ্ন হাজির করে। সুলতানার যে স্বপ্ন, রোকয়া তার কলমে আকার দিয়েছিলেন, তা এই সময়ে আসলে কীভাবে পাঠ হবে?

একেক শিল্পী একেকভাবে দেখেছেন বিষয়টিকে। সাজিয়া রহমান সন্ধ্যা যেমন ‘কাদেরাবাদের গল্প’ শীর্ষক শিল্পকর্মে নিত্যকার পথচলতি কর্মজীবী নারীদের দিকে একটু পূর্ণচোখে তাকানোর আহ্বান করেছেন। ভিডিও আর্টের সঙ্গে দেয়ালে থাকা তাদের ভাষ্য, তাদের দীর্ঘশ্বাস ও সংগ্রামের শব্দমালা ভাবতে বাধ্য করে। আবার ফারিহা জেবার ইনস্টলেশন ‘শোনো’ শব্দের পুনঃপুনঃ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য করেছে।

এর মধ্যেই শিশুদের কলকল কানে আসে। প্রদর্শনকক্ষের দরজার ঠিক সামনেই। কাছে গেলেই কানে আসে একটা হামিং। কে যেন গুনগুন করছে। চোখ চলে যায় ডান পাশের দেয়ালজুড়ে চলতে থাকা ভিডিও আর্টে। একটু থিতু হতেই বোঝা যায়–‘আমার মন মজাইয়ারে’ গানটি গেয়ে চলেছেন এক বাউল। ক্রমে তিনি প্রকাশ্য হন। নকশি কাঁথার নানা মোটিফ তাকে ঢেকে দিতে থাকে। তার পাশেই এক ছায়া শরীরের নারী গানের তালে দুলছেন। এই ভিডিও আর্টের সামনেই আংশিক ছড়িয়ে থাকা নকশি কাঁথা, না ঠিক চিরায়ত নয়, সুতার বদলে রঙের আঁচড়ে নকশি কাঁথার মোটিফ দিয়ে ক্রম প্রকাশমান কাঁথা নজরে আসে। কাঁথার পাশেই আছে রং, তুলির সমাবেশ। ভিডিও আর্টের সন্নিহিত দেয়ালে একের পর এক নকশি কাঁথার ফটোগ্রাফ এবং তাতে লেখা মানুষ বা ফিগারের শনাক্তচিহ্নসমেত কাগজ সাঁটছেন শিল্পী দীপ্তি দত্ত। এই ফিগারগুলো শনাক্ত করেছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ঘুরতে আসা স্কুল শিক্ষার্থীরা। গত ৮ আগস্ট লেখক যখন প্রদর্শনী ঘুরতে যান, সেদিনই এসেছিল শিক্ষার্থীরা। শিল্পী জানালেন–এটা তার চলমান গবেষণা। দর্শকদের কাছ থেকেই তিনি চিনে নিতে চান চিরায়ত নকশী কাঁথায় থাকা মানুষ মোটিফগুলোর পরিচয় ও কর্মপরিধি। ঘুরতে আসা শিশুরা তাতে অংশ নিয়েছে।

দীপ্তি দত্ত তার শিল্পকর্মকে ডাকছেন ‘স্বপ্নের বাইরে থেকে’ নামে। কেন? তিনি প্রশ্ন করছেন খোদ ‘সুলতানার স্বপ্ন’কেই? রোকেয়াকেই? তিনি সরাসরি প্রশ্ন করছেন–এই স্বপ্নের বাইরে সুলতানার সময়ে ভিন্ন বাস্তবতা কি ছিল না? ঠিক একইভাবে আরেক শিল্পী সুলতানার নয়, দর্শনার্থীদের স্বপ্নের হদিস নিতে চাইছেন।

এ বছর বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ প্রকাশের ১২০ বছর পূর্তি। ছবি: চরচা
এ বছর বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ প্রকাশের ১২০ বছর পূর্তি। ছবি: চরচা

এখানে বলা যায় রুক্সমিনি চৌধুরীর ‘যেসব ঘটনা নিশ্চিতভাবে ঘটেনি’ শিল্পকর্মের কথা। একটা স্বপ্ন। সেটা সুলতানার না হলেও নারীর শরীরের নিয়ন্ত্রক বনে বসে থাকা এই পুরুষপ্রধান সমাজের বিপরীতে হাজির করে দৃঢ় বিরোধ। এই বিরোধ আমাদের মনে করিয়ে দেয় বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তবতার কথা। দীপ্তি দত্তের বাউল, রুক্সমিনি চৌধুরীর নিজস্ব স্বপ্নের বয়ান, জাফরিন গুলশানের রেহাল কিংবা রাজীব দত্তের সেই বালুচাপা নারীর জোড়া হাত অথবা সেই পুরুষের বুকে খচিত ‘নিরাপত্তা’ থেকে ‘নির্যাতন’-তক শব্দগুচ্ছ বাতাসকে ভারী করে আবার করে না। আমরা নারীর দুঃখ, নারীর ভাষ্য, নারীর কণ্ঠগুলোকে, তার প্রতিবাদ ও প্রশ্নকে শিল্প হয়ে উঠতে দেখি রাজধানীর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। আর এই শিল্প হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে তা কি কিছু হলেও প্রচ্ছন্ন হয়ে ওঠে? নারীর সংগ্রাম দেয়ালে দেয়ালে, ইনস্টলেশনে ঠাঁই খুঁজতে খুঁজতে শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট নাগরিক বলয়েই আটকে পড়ে কি? দীপ্তি দত্তের তোলা প্রশ্নের মতো করে বলতে হয়, রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্নে সংগ্রামশীল নারীর বাস্তবতা যেভাবে বা যে প্রকরণে নিরুদ্দেশ মেনেছিল, ঠিক সেভাবে নাগরিক পরিসরের এমন প্রদর্শনীও কি তার শিল্পরসিকদের বাইরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করছে না? এও কি সেই ‘নারী জাগরণের অগ্রদূত’ রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের মতো করে বৃত্তবন্দী দেখার প্রয়াসই কেবল? অগণিত নারীর কণ্ঠ ও তার সংগ্রাম কি এখানে অনুল্লেখের নিয়তি মেনে নিচ্ছে না?

সম্পর্কিত